মনের মণি – মণিমহেশ

Published by Editor on

মণিমহেশ

মনের মণি – মণিমহেশ

– সুমন্ত মিশ্র

মণিমহেশ এ চলেছি। হিমতীর্থ হিমাচলে মণিকৈলাসের পথ। সেখানে মেলা বসে প্রতি জন্মাষ্টমি তিথিতে, শেষ হয় রাধাষ্টমিতে। চাম্বা থেকে ভারমৌর হয়ে হাডসার, এখান থেকে পায়ে হাঁটা শুরু। হাডসার যখন পৌঁছলাম তখন বিকেল ৪টে, -পাহাড়ের ঢালে বড় বড় দেওদার-এর ছাওয়ায় ঘেরা ছোট্ট একটুকরো জায়গা। -তিন দিকে অতল খাদ, নিচে বয়ে চলেছে ভুডল নদী। একদিকে উত্তুঙ্গ পাহাড়ের কোল ধরে পায়েহাঁটা পথ উঠে গেছে ধানছো হয়ে মণিমহেশের দিকে।

এখানে দেরিতে সন্ধ্যে হয়, -তাই জিপ থেকে নেমেই হাঁটা দিলাম ধানছোর পথে, সেখানেই আজকের রাত্রিবাস। চলেছি অসংখ্য পূণ্যার্থীকে সঙ্গী করে, -রাস্তার বাঁপ্রান্তে খাদের দিকে পশ্চিম মুখে আমরা, আর যাঁরা ফিরছেন তাঁরা পূবমুখি – পাহাড়ের কোল ঘেঁষে। – সকলের মুখেই শিব ভজনা। গন্তব্য যখন শিবতীর্থ মণিমহেশ, তখন এটাই স্বাভাবিক! –গলা মেলাই সবার সাথে, -ওঁ নমঃ শিবায়। কাতারে কাতারে মানুষ, – কচি-শিশু থেকে বয়ঃ-বৃদ্ধ, -পূণ্যার্থী সবাই! সকলেই প্রায় খালি পা, নামমাত্র শীতবস্ত্র পরে চলেছেন তাঁদের আরাধ্য দর্শণে! হিমালয়ের পাথর বিছানো পথে এঁদের চরণযুগলে মনে মনে প্রণাম জানাই! নিজেদের সুসজ্জিত অবস্থায় এই প্রথম বড় বেমানান্ লাগে! ভাবি, – অন্যসময় জনপ্রাণহীন এই পথে এসেই আমরা সুসজ্জিত পর্যটকরা কি বাহদুরিই না দেখিয়ে থাকি।

এদিকের রাস্তা বেশ প্রশস্ত, -পাশাপাশি চারজন হাঁটা যায়। মিনিট ১৫ চলতেই রাস্তার ধারে সারি সারি ভান্ডারার দেখা মিলল। ভান্ডারা, -এর সাথে আমার এই প্রথম পরিচয়! বিস্তারে বললে, -বিনাপয়সায় খাবারের পসরা! – কত রকমের খাবার, -লুচি-তরকারি, সিঙ্গাড়া, জিলেপি, সুজি –অফুরন্ত খাবারের ভান্ডার, -ভান্ডারা! যাত্রীরা নিজেদের পছন্দ অনুযায়ী খাবার খাচ্ছেন, গৌতম-প্রণবও যোগ দেয়, -ওদের পছন্দ গরম জিলেপি! ধীরপায়ে আমি খানিকটা এগিয়ে যাই। এত লোক, তাঁদের ধর্ম নিয়ে এই আবেগ, -আরাধ্য দর্শণে এই নিষ্ঠা, ত্যাগ সবকিছু মনকে অভিভূত করে! “যে সভ্যতা আপনার সমস্ত ব্যবস্থাকে সরলতার দ্বারা সুশৃঙ্খল ও সর্বত্র সুগম করিয়া আনিতে পারে সেই সভ্যতাই যথার্থ উন্নততর। বাহিরে দেখিতে যেমনই হউক জটিলতাই দুর্বলতা, তাহা অকৃতার্থতা ; পূর্ণতাই সরলতা। ধর্ম সেই পরিপূর্ণতার, সরলতার, একমাত্র চরমতম আদর্শ।“ – রবি ঠাকুরের এই কথাগুলি আজ, মণিমহেশের পথে সরল হয়ে মনের মাঝে পূর্ণতা পেল!

একটানা সোয়া২ঘন্টা হেঁটে পৌঁছলাম ধানছো। উমাপ্রসাদের ‘বিস্তীর্ণ মালভূমি’ এখন জনঅরন্য! কোথায় ‘সবুজ গালিচা’, যেদিকেই তাকাই শুধু তাঁবু আর মানুষের ভীড়! চারদিকে মানুষের কোলাহল, ঢাক-ঢোল-কাঁসরের আওয়াজ, সরকারি দফতরের মাইকে ঘোষনা – সবকিছু মিলিয়ে মৌনি হিমালয়ের মৌনতা ভঙ্গের সব আয়োজন-ই বেশ সুসম্পূর্ণ! ভীড়ের মাঝেই অস্থায়ী সরকারি দফতরে খোঁজ নিয়ে, -মালভূমির মাঝখান দিয়ে বয়ে যাওয়া জলের ধারা পেরিয়ে গেলাম রাত্রিবাসের তাঁবুর সন্ধানে! সার সার তাঁবুর মাঝেই মিলল চারজনের থাকার উপযোগী একটি তাঁবু –তাতেই আমাদের ৩জনের রাত্রিবাস।

রাত্রির ঐ হট্টগোলের মাঝে কখনো কখনো হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছি, কিন্তু বারেবারেই তাতে ব্যাঘাত ঘটেছে! আজ রাধাষ্টমি, -মেলার শেষ দিন, সকলের মধ্যে ব্যস্ততাও যেন একটু বেশী! –তাই ভোর হতেই আমাদেরও যাত্রার প্রস্তুতি শুরু! ঠিকহয় মালপত্র তাঁবুতে রেখেই আজ যাওয়া হবে মণিমহেশ দর্শণে, – দর্শণ শেষে আজই আবার এখানে ফেরা! সকাল ৭টায় ছাতুর সরবত্ গলায় ঢেলে যাত্রা শুরু। তিনদিক উঁচু পাহাড়ে ঘেরা জায়গা, – ধাপে ধাপে পাথর কাটা বিষম চড়াই উঠে গেছে মনিমহেশের দিকে। প্রায় একঘন্টা হাঁটলাম, বিশ্রাম নিতে দাঁড়িয়ে পিছন ফিরতেই দেখি ধানছো জ্বলজ্বল করছে! হতাশায়, বিরক্তিতে সবারই মেজাজ খারাপ হয়, -‘এতক্ষনে এইটুকু এলাম’! আরও আধঘন্টা চলার পর পেরিয়ে আসি বাঁন্দরঘাঁটির চড়াই, -দুর থেকে দেখে যেখানে চড়াইয়ের শেষ মনে হচ্ছিল, সেখান থেকেই শুরু ভৈরবঘাঁটির প্রাণান্তকর চড়াই! নিস্তারহীন চড়াই উঠি ধীর পায়ে, – ফিরতি যাত্রীরা জয়ধ্বনি দেন “হর হর মহাদেব” – আমি সেটুকু বলার শক্তিও হারিয়েছি! আমার পরিশ্রান্ত শরীর দেখে অনেকেই উৎসাহদান করেন, – বিশেষ কাজ হয়না! চড়াইয়ের পর চড়াই ভেঙ্গে একসময় বসেপড়ি, পা যেন আর চলে না! চারিদিকে সাদা মেঘের আস্তরণ, দু’হাত দূরের জিনিসও দেখা যায়না, -শুরু হয় সাবুদানার মত বরফ পড়া! চোখবন্ধ করে কতক্ষন বসেছিলাম জানিনা, -পিঠে নরম স্পর্শ, -“বেটা, পরিসান্ হো?” চোখ খুলি, সামনে এক করুণার মূর্তি – শিখ্ বৃদ্ধ! বৃদ্ধ নিজের ঝোলা থেকে একমূঠো কাজু-কিসমিস্ বার করে দেন, -খেয়ে নিতে বলেন, -বলেন, পথ আর বেশী নেই, সামনেই গৌরীকুন্ড, -সেখানে ভান্ডারায় জল, খাবার সব পাব, তারপর আধঘন্টার পথ, তাই খোলা জায়গায় বসে না থেকে আমি যেন হাঁটা লাগাই! কি বিষম এক শক্তি ছিল সেই বৃদ্ধ মানুষটির কথায় – তা আজ এত বছর পরে ভাবলেও শিহরিত হই! দু’পায়ে নতুন করে বল ফিরে পাই – হাঁটা লাগাই গৌরীকুন্ডের পথে! মিনিট দশেক হাঁটতেই দেখামেলে বরফ আর পাথরে ঘেরা ছোট্ট অপরিসর প্রান্তর – গৌরীকুন্ড, -বাঁপ্রান্তে জলের ধারার নীচে তীর্থযাত্রীদের পরম পবিত্র ছোট্ট হ্রদ! মেঘের চাদর ছিঁড়ে দেখাদেন সূর্যদেবও! ভান্ডারায় খাওয়া সেরে আধঘন্টার চড়াই ভেঙ্গে উঠে আসি – মণিমহেশ! ঘড়িতে সোয়াদুটো। -চোদ্দ হাজার ফুট উচ্চতায় প্রকান্ড এক ‘লেক’! – অসংখ্য তীর্থযাত্রী তাতে পূণ্যস্নান সারছেন, ধূপ জ্বেলে, নারকেল ভেঙ্গে পূজো দেওয়া হচ্ছে! আমার মন পড়ে আছে দিগন্তের উত্তর পানে – মণিকৈলাসের দর্শণে! দর্শণ মেলে – মাত্র কয়েক মিনিটের জন্য মেঘের আস্তরণ সরিয়ে দেখাদেন তিনি – মণিমহেশ শিখর! – যেন শিবভুমি কৈলাসের ছোট সংস্করন! হাতজোড় করে প্রণাম জানাই।

মণিমহেশ সূর্যোদয়

সাড়ে-চারঘন্টা উৎরাই শেষে সোয়া সাতটায় তাঁবুতে ফেরা! রাত্রির খাবার সেরে তাঁবুতে শুয়ে অনেকক্ষণ ঘুম আসেনা, -মাথায় ঘুরতে থাকে দু’দিনের বিস্ময়কর অভিজ্ঞতার কথা! – মণিমহেশ হিন্দু তীর্থ, কিন্তু রাস্তায় যা দেখলাম, -তীর্থযাত্রীদের শতকরা ষাট ভাগ-ই শিখ! এমনকি রাস্তায় এত যে ভান্ডারা, তার সবক’টির পরিচালনার দায়িত্বেও ঐ শিখ সম্প্রদায়ের মানুষেরাই! আজই রাত্রে খাবার শেষে প্রণব ভান্ডারায় পরিবেশনরত এক শিখ যুবককে জিজ্ঞেস করে বসল, -“ভাইয়া, ইয়েতো হিন্দু তীর্থ হ্যায়, ফিরভি আপলোগ ইঁহা ভান্ডারা খোলে কিঁউ?” শিখ্ যুবকটি বেশ ক্ষোভের সাথেই উত্তর দিল, -“শিউজি অউর গুরুজি একহি হ্যায়, আপলোগ সায়েদ আলগ্ সোচতে হ্যায়, হামলোগ নেহি!” প্রণব লজ্জিত হয়, -আমরাও! নিজেদের সংকীর্ণ ভাবধারায় নিজেরাই সংকুচিত হই! যাঁরা ধর্ম নিয়ে জীবনভর অকথা-কুকথা বলে বেড়ান, মনিমহেশের পথ তাঁদের নতুন করে শিক্ষা দিতে পারে।

মণিমহেশ মনের মণিকোঠায় চিরস্থায়ি হয়ে আছে, – মণির আলোকে আমার দেশকে নতুন করে চিনতে শিখিয়েছে! আজও হিমালয়ের পথে পরিশ্রান্ত শরীর খুঁজে বেড়ায় সেই স্নেহ স্পর্শ, – কানে বাজে করুণাসিন্ধুর বাণী –‘বেটা, পরেসান্ হো?’


0 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!