A-Z informations and Mind blowing travel story on Dooars, North Bengal

অরণ্য গাথা – ডুয়ার্সের আলোছায়ায়

Published by Editor on

অরণ্য গাথা

– অর্ণব মাইতি

পর্ব ১ : ডুয়ার্সের আলোছায়ায়  

সন্তের স্নিগ্ধ সমীরণ, দোল পূর্ণিমার সর্বব্যাপী চন্দ্রিমার প্লাবন,মাতাল মন  তির তিরে  মূর্তি নদীর শ্বেত শুভ্র  বালুকা রাশির মাঝে ,দুধারে বনজ্যোৎস্নার সবুজ সাঁজে নিজেদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সত্তাকে বৃহৎ প্রকৃতির মাঝে মিলিয়ে একাকার করে দেয় ।

কি রুপ ! কি অমোঘ আকর্ষণ ! পাগল হয়ে আমরা ছুটেছি নিজেদের হৃদয়ের দোলাচল কে,সত্তার অপূর্ণতাকে নিয়ে সেই অরূপের বাহুডোরে বিলীন করে চন্দ্রাহত মূর্তির অবগাহনে।

কিন্তু হায় আলিঙ্গনের মধ্যে পাই যতটুকু তার চেয়ে অনেক বেশি থাকে বাইরে পড়ে । মন চাইলেও যাকে ছোঁয়া র সাধ্য আমাদের নেই ।বিশ্বরূপ দর্শন যেন একখানি স্ফুলিঙ্গ ।মুহূর্তে ঝলসে ওঠে কিন্তু তার রেশ থেকে যায় বহুক্ষণ।

রাত ন’টা থেকে প্রায় এগারোটা,দীপ্ত দা  একটার পর একটা রবীন্দ্র সংগীত গেয়ে চলেছে, অভিজিৎ উঁচু  টিলায় চুপ করে শুয়ে আছে আর অনির্বাণের যেন পুনর্জন্ম হলো ,প্রায় জন্মদিনের পোষাকে ছুটে চলেছে চন্দ্রালোকিত মূর্তির জল রাশির মাঝে সম্পূর্ণ অবগাহনে। সুমনের প্রাণ খোলা হাসির রেশ , প্রতীকদার আবেগ বিহ্বল দৃষ্টি,সুদীপদার ক্রমাগত নুড়ি পাথর এর আকর্ষণীয় শিল্প সৃষ্টি, অর্ণবের নদীর তলদেশের শ্বেত শুভ্র বালুকারাশিকে দু হাতে ধরে চন্দ্রিমা কে স্পর্শ করার প্রচেষ্টা – সবাই হারিয়েছে নিজেকে এই  রুপালি নদী বালির সবুজ  বন পাহাড়ে ……..।

এই জ্যোৎস্নামাখা নদী অরণ্য পাহাড়ের গল্পলোক ছেড়ে সারথি রাজু পুনরায় গাড়ি নিয়ে চলল কংক্রিটের  টুরিস্ট লজে। ফেলে এলাম এক চির অবিস্মরনীয় রাত্রি ,এক চির অবিস্মরণীয় মুহূর্ত, এক অবিস্মরণীয় আত্মভোলা মন গুলিকে।

আমরা কয়েকজন একটি কারিগরি শিক্ষা  প্রতিষ্ঠান সঙ্গে যুক্ত। প্রযুক্তি আমাদের পেশা। কম্পিউটার এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস আমাদের নেশা। কলেজে সেমিস্টার এক্সাম চলেছে। এরকম এক পরীক্ষা বিরতি দিনে আমাদের সমমনস্ক কয়েকজন সহকর্মী আড্ডার মেজাজে আছি। এমন সময় কম্পিউটারের সামনে বসে  আমাদের এক সহকর্মী অনির্বাণের প্রস্তাব ভেসে এলো , “চলো জঙ্গলে যাই। “

হাস্য রোল উঠলো, জুন মাসের গরমে এসি ল্যাবের  আরামদায়ক রিভলভিং চেয়ারে কম্পিউটার সামনে  বসে ‘জঙ্গল!’। আধুনিকতম স্থানে বসে আদিমতম স্থানের কল্পনা !

সাময়িক অস্বস্তি কাটিয়ে অনির্বান বলে উঠলো একটা সিনেমা দেখা যাক সত্যজিৎ রায়ের “অরণ্যের দিনরাত্রি”। অদ্ভুত ভাবে সবাই সায় দিলাম ,কেউ পূর্বে দেখেছি, কেউ দেখিনি কিন্তু সবাই মনোযোগী ,বুঝলাম কোথাও আমাদের মধ্যে একটা মিল আছে । আধুনিক রংমাখা মেকআপ করা ,জানা দুনিয়ার কৃত্রিমতার বাহিরে এক অজানা ,স্বাভাবিক ,প্রকৃতির রঙে রাঙানো কালচে সবুজের বিশুদ্ধ দুনিয়ায় প্রতি অকৃত্রিম টান।

দোল পূর্ণিমার প্রাক কালে 20শে মার্চ ব্যান্ডেল থেকে চেপে বসলাম কামরূপ এক্সপ্রেসে। ভোরে এনজিপি তে  নেমে কাঞ্চনকন্যার বন্যতার গন্ধমাখা সর্পিল পথে পৌছালাম নিউ মাল জংশনে । উপস্থিত আমাদের সারথি রাজু তার গাড়ি নিয়ে। সেই শুরু, তারপর সারথি অনেক দেখেছি কিন্তু সত্যি কারের মন নিয়ে   ভ্রমনিক দের হৃদয়ের পাত্রখানি রূপ- গন্ধ-রসে উপচে ফেলতে  রাজুর মত আর কাউকেই দেখিনি। এরপরেও বহু ভ্রমণের সঙ্গী,সারথি নয় ,আমাদেরই একজন হয়ে উঠেছিল, সে কথা পরে বলবো।

 আপাতত ,রাজু আমাদের নিয়ে চলল গরুমারা এলিফ্যান্ট ক্যাম্প, ধূপঝোরা এর অভিমুখে । এটি গরুমারা অভয়ারণ্য এর প্রান্ত দ্বারে। পশ্চিমবঙ্গ সরকারের বনদপ্তরের খুব যত্নের প্রয়াস। প্রতীকদার মামা একজন উচ্চপদস্থ বন বিভাগের আধিকারিক, তার সৌজন্যেই এই প্রাপ্তি। একটি সুন্দর গাছ বাড়ি আছে, এছাড়াও কটেজখুলি খুবই মনোরম ।আধুনিক সব ব্যবস্থা বর্তমান । গাছবাড়ির বাথরুমের শাওয়ার এ স্নান করে প্রাণে প্রশান্তি এল। কিন্তু আমাদের মনে বন্যতা বাসা বেঁধেছে ,সেখানে বদ্ধতা বড় দুর্বিষহ। তা যতই সুযোগ-সুবিধা থাকুক না কেন? এ যেন এক ঝাঁক মুক্তমনাকে খাঁচায় বন্দি করে অভয়ারণ্য কর্তৃপক্ষের মর্জি মতন আনন্দ প্রদান। অতএব মুক্তির প্রয়াস।সাথী মুক্তমনা রাজুও । প্রসঙ্গত বলে রাখা ভাল, রাজুর মতন রত্ন প্রাপ্তিও পথিকদা কাকা শ্বশুরের দান।

অবশ্যই জঙ্গলের তীব্র আকর্ষণ ও আস্বাদেনর জন্য আমাদের প্রাণ ব্যাকুল হয়ে উঠেছিল। ফরেস্ট বিট অফিসার সুনীল বাবু  জঙ্গলের জন্য সংরক্ষিত জিপসি গাড়িতে আমাদের ঘুরিয়ে দেখালেন স্যাংচুয়ারির বিস্তীর্ণ বনভূমি । বাঁকে বাঁকে অজানা বন বাসিন্দাদের প্রত্যাশা, ছম ছমে  আলো আঁধারী গহীনে ডুয়ার্সের জঙ্গলের প্রথম স্বাদ গ্রহণ ।দেখলাম গরুমারার দুই খানি রত্ন । রাইনো পয়েন্ট ও যাত্রা প্রসাদ ওয়াচ টাওয়ার।  তরাই ডুয়ার্স এর অন্তর্গত গরুমারা স্যাংচুয়ারি মূলত সাভানা ও গ্রাসল্যান্ড তৃণভূমির অন্তর্গত। এই দুটি পয়েন্ট থেকেই প্রচুর  ভারতীয় বাইসনের বা গৌড় ,গন্ডার এর উপস্থিতি চোখে পড়ে। রাইনো পয়েন্ট প্রায় 150 ফুট নিচ দিয়ে বয়ে গেছে ইনডং ঝোরা । হলুদ পা ওয়ালা সবজে টিয়া পাখির ছড়া-ছড়ি এখানে। দুখানি সল্ট লিক রয়েছে। বেশকিছু চিতল সেখানে নুনের সন্ধান এসেছে।ঝলসে উঠে ময়ূরের পেখম। বেশ দূরে দূরবীন চোখে পড়ে একদল সাদা মোজা পরা গৌড় বা ভারতীয় বাইসন । রাইনো পয়েন্টে  হাতিদের একটি শুশ্রূষা কেন্দ্র রয়েছে। বেশ কিছু বাচ্চা হাতি ও চোখে পরল। একজন তো আবার সুদীপদার আদরে উৎসাহিত হয়ে সুদীপদার পিছন ছাড়তে  চাইছিলো না। তবে সে যাত্রায় আমরা বাচ্চা হাতিটি কে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে তার আদরের হাত থেকে ধরাশাহী সুদীপ দা কে রক্ষা করি। তবে রাইনো পয়েন্টে রাইনো অর্থাৎ গন্ডারের দেখা পায়নি।

যাত্রা প্রসাদ হল এক প্রশিক্ষিত মহিলা হাতি। অত্যন্ত কৌশলী ও বিশ্বস্ত। দুরন্ত দক্ষতা ও দায়িত্বের সঙ্গে অভয়ারণ্যের জরিপ এবং চোরা শিকারীদের সঙ্গে লড়তে বনকর্মীদের প্রচুর সাহায্য করেছিল। তাই তাঁর মৃত্যুর পর তাঁর স্মরণে বনদপ্তর যাত্রা প্রসাদ এর এক বিশাল প্রতিমূর্তি স্থাপন করেছিল। কিন্তু কালক্রমে বন্যহাতি দল সেটি ভেঙে দেয়, পরে বনদপ্তর একটি টু টায়ার ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করে তার নামকরণ করে যাত্রা প্রসাদ। এই ওয়াচ টাওয়ারে উঠে প্রথম দেখলাম মূর্তি নদী কে, তারপর যথারীতি সাভানা খাসজমি, দূরে জলঢাকার ক্ষীণরেখা এবং তার পিছনে বামনডাঙ্গার চা বাগিচা। দূরবীন নিয়ে আমরা যখন দূরের প্রত্যাশায় তখন অনুসন্ধিৎসু সুমন দেখিয়ে দিল একদম সামনে মূর্তির পাশে অজস্র স্পটটেড ডিয়ার ।

বিট অফিসার সুনীলবাবুকে অনেক অনুরোধ করেও গরাতি দর্শন হলো না।  গরাতি গরুমারার দুর্ভেদ্য এলাকা। গভীর জঙ্গলের মাঝে একখানি ভগ্নপ্রায় কংক্রিটের ওয়াজ টাওআর অবস্থিত। সুনীল বাবু বললেন,আপনাদের অনুরোধ রাখা অসম্ভব। আমিও কোনদিন গরাতি যেতে পারিনি। একমাত্র D.F.O.  ও কনজারভেটিভ অফিসার বা তাদের অনুমতি  ছাড়া ওখানে কেউ যেতে পারে না। আপনারা আমার সম্মানীয়  অতিথি কিন্তু দয়া করে মাফ করবেন।

দুপুরে পর জিপসি নিয়ে ফেরার পথে । গরুমারা জুড়ে শাল, শিরীষ, শিমুল ,টিক ,খইরি গাছের বুনোট সমাহার । ফিঞ্চ, স্যাটায়ার পাখিরা ঝাকে ঝাকে এই গাছ থেকে ও গাছে ঘোরাঘুরি করছে। দু-একটা ধনেশ পাখি, অজস্র ময়ূর এবং উড়ন্ত কাঠবিড়ালি দেখা পেলাম। বুনো শুয়োররা দ্রুত রাস্তা পেরিয়ে যাচ্ছে । একটা নীলগাই ঘাড় ঘুরিয়ে আমাদের দেখলো । আর প্রচুর হরিণ, একটা বার্কিং ডিয়ার ও চোখে পড়লো । ইকো রিসোর্টে ফিরে দেখলাম মাহুতরা কুনকি হাতিগুলোকে নদীতে স্নান করিয়ে নিয়ে আসছে। গরুমারা কে আপাত বিদায় জানিয়ে আমরা পুনরায় রাজুর গাড়িতে সয়ার হলাম ।

Debgram

এতক্ষণ নতুনের আস্বাদনে বুঁদ হয়েছিলাম ,ফেরার পথে মালুম হলো পেটের কীর্তন। গতকাল রাতে মালদা ষ্টেশনে পাতলা রুটি তরকারি আর আজ সকালে এনজিপি তে চা-বিস্কুট ছাড়া কিছুই পেটে পড়েনি। এখন প্রায় বেলা সাড়ে তিনটে। বনে জঙ্গলে দোকান বাজার নেই। জঙ্গল ক্যান্টিনে আগে থেকে অর্ডার দিয়ে রাখতে হয়। তবে উপায়? অবশেষে যে বস্তুটি চিরকাল বিপদে তার সহৃদয় হাত বাড়িয়ে দিয়েছে সেই ছাতুর সরবতে এ যাত্রায় আমাদের পাকস্থলীর সংকটমোচন ঘটলো। সন্ধ্যার মুখে পৌছালাম মালবাজার টুরিস্ট লজে। রাতে রাজু প্রস্তাব দিল  মূর্তির চড়ে ঘুরে আসি। কেউ কেউ অবশ্য সাপ, জন্তু-জানোয়ার ইত্যাদির কথা বললো, কিন্তু বনে এসে বন্য হবোনা? তাই এই যুক্তি ধোপে টিকলো না। আর টিকলো না বলেই তো পেলাম সেই অত্যাশ্চর্য অরূপরতন কে, যার রূপকথা দিয়ে শুরু হয়েছে আমার অরণ্য গাথা।

হিমালয়ের পাদদেশের অজস্র তুষার গলা জল-জালিকায় উর্বর ভূখণ্ডে গহীন অরণ্যের মধ্যে অপরূপা ডুয়ার্স বা তরাই। পশ্চিমে তিস্তা ও পূর্বে আসামের ধানসিঁড়ি নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল। মাঝে তরাই কে পূর্ব-পশ্চিমে বিভক্ত করেছে সংকোশ নদী।পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গের এবং পূর্বে আসামের তরাই অঞ্চল।এই অঞ্চলের উত্তরে ভুটান,থরে থরে সাজানো হিমালয়ের চির তুষার শৃঙ্গ গুচ্ছ। একেবারে পাদদেশে থাকায় তাকে দেখা যায় না বটে কিন্তু নদী গুলির হিমশীতল জলের স্পর্শে অনুভব করা যায় সেই মহান কে।

পরদিন রাজু মণি মুক্তোর মতো সাজানো অসম্ভব সজীব প্রাকৃতিক দৃশ্যাবলী কে আমাদের সামনে উপস্থাপিত করল। প্রথমে চালসা হয়ে ঝালং। পাহাড়ের কোলে একটি কফিশপ,পাশে জলঢাকা নদী। নিচে দেখা যায় জলবিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র। নদীর ওপারে ভুটান।নীল আকাশের নিচে ভুটানের নীলচে সবুজ পাহাড়শ্রেণি ।আরো কিছুদূর যাবার পর ভুটান সীমান্তে  ভারতের শেষ জনপথ বিন্দু। সামনে একটি লোহার ব্রিজ । ব্রিজ পার হলেই ভুটানের টেন্ডু অঞ্চল। জায়গাটি একটি সুরু গর্জ এর মতন। এখানে জলঢাকা নদী বিন্দু খোলা এবং দুধ পোখরি  নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে তীব্র গর্জন করছে এবং চারিদিকে ব্যাপ্ত করেছে বিন্দু বিন্দু জলকণায়, সূর্য রশ্মির সংস্পর্শে যা সাতরঙা। মনে পড়লো আজ হোলি ।সত্যি আজ সার্থক হলো আমাদের হোলি খেলা । নদী গহবর থেকে উৎসারিত বিন্দু বিন্দু জল কণার সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের আবিরের আদরে আমাদের সর্বাঙ্গ রঙিন।

এরপর চালসায় মধ্যাহ্নভোজন ছেড়ে চালসার এর অনবদ্য চা বাগিচার মধ্য দিয়ে এঁকেবেঁকে ক্রমশঃ মেটালি এর চা বাগিচা সমৃদ্ধ জনপদের মধ্য দিয়ে উঠে এলাম সামসিং।এখানেও দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ ঢেউ খেলানো চা বাগিচা। তবে এর পরই নেওড়া ভ্যালি ন্যাশনাল পার্কের সীমান্তবর্তী অঞ্চল। প্রকৃতির রূপ পরিবর্তন। শুরু হলো ঘন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে হাঁটা পথ। শাল, সেগুন,বহেড়া, শিমুলের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে রংবেরঙের প্রজাপতির ডানার অবগুন্ঠনে আবৃত হয়ে অজস্র বুনো ফুলের গন্ধে মাতোয়ারা মন এগিয়ে চলল, সাথে ছিল সবুজ ছাতারে, কালো শালিক,নীল কাঠঠোকরা আর লাল বুলবুলি। দূরে নেওড়া ভ্যালি জঙ্গলের উঁচু-নিচু টিলাগুলোর চোখে পড়ছিল। ওরই কোন একটি সুউচ্চ লোকালয় হীন টিলায় অবস্থান করছে অসাধারণ এক বন বাংলো – মৌচাকী । মনের কোণে উঁকি মারছে সেখানে যাওয়ার আহবান। অবিশ্বাস্য সুন্দর এই পথ চলা। দেখতে দেখতে পাঁচ কিলোমিটার পেরিয়ে সুলতানি খোলার উপর একটি ঝুলন্ত সেতু পেরিয়ে পৌছালাম ওয়েস্ট বেঙ্গল ফরেস্ট ডেভেলপমেন্ট কর্পোরেশন এর নেচার রিসোর্টে। একথা স্বীকার করতেই হবে রিসোর্টের  জায়গা নির্বাচন এককথায়  অনন্য, অনবদ্য। পাশে সেই মোহময়ী মূর্তি।অসাধারণ মন মাতানো প্রকৃতিতে আত্মহারা হলাম আর আত্মবিলীন হলাম  সুন্দরী পাহাড়ি মেয়েদের দেখে, যাদের চোখের নীল তারায় সত্যিই কুয়াশাঘেরা নীল পাহাড়ের বুনো সবুজের  অমোঘ আকর্ষণ। আমাদের রঙের উৎসব হোলি আজ সত্যিই সার্থক । এত রং আগে কখনো অনুভব করি নি !

ফেরার ফেরার পথে রাজু আমাদের নিয়ে চলল চালসার এক প্রাইভেট চা বাগানের মধ্যে। ম্যানেজার রাজুর পূর্বপরিচিত। তাই অনুমতি পাওয়া গেল। সেখানে গিয়ে দেখা গেলো কিছু কুলি কামিন এদিক ওদিক জড়ো হয়ে ভয়ার্ত গলায় কথা বলছে। হাতে তাদের লাঠিসোটা। তাদের কথায় বুঝলাম চিতাবাঘের উপদ্রব ঘটেছে। শুনে সুদীপ্ দা তো ভয় পেয়ে চা গাছের নিচেই লুকিয়ে পরল। অভিজিৎ বলে উঠলো “আরে চিতাবাঘ তো চা বাগানের গাছের নিচে লুকিয়ে থাকে। তোমাকেই এবার ওরা চিতাবাঘ না ভেবে তাড়া করে । দীপ্ত  দা টিপ্পনী কাটলো,” চিতাবাঘেরাও তাদের দোসর মনে ঘাড়ে চুমু খেতে পারে ।” সুদীপ দা তখন রেগে “চল চল চল ঊর্ধ্ব গগনে বাজে মাদল” ভঙ্গিমায় রেগে গট গট করে সামনে এগিয়ে কুলি কামিনদের নিরাপদ আশ্রয়ে দাঁড়ালো । রাজু আমাদের কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছিল। রাতের কুয়াশা ও জ্যোৎস্না মাখা চা-বাগান কে বিদায় জানিয়ে আবার টুরিস্ট লজে ফিরে এলাম। মনের ভিতর প্রাপ্তির এক অদ্ভুত অনুভূতি।

পরদিন সকালে প্রাতরাশ সেরে বেরিয়ে পড়লাম। সেই দিগন্তবিস্তৃত ঢেউ খেলানো চা বাগিচার মাঝে কালো অজগরের  ভিজে গাএর মতন পথ এঁকেবেঁকে চলেছে কোন অজানার উদ্দেশ্যে, পৌঁছে দেবে কোন নীল পাহাড়ের বাঁকে। ভুট্টা বাড়ি, গরুবাথান মধ্য দিয়ে  রিশি রোড ধরে অজস্র চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পৌছালাম 7700 ফুট উঁচু লাভা জনপদে । ধুপি, সাইপ্রাস, বার্চ ইত্যাদি জঙ্গলে আবৃত লাভা। রাস্তার পাশেই এক অপূর্ব গঠনশৈলীর মনাস্ট্রি,যার ভাবগম্ভীর পরিবেশ যে কোন মানুষের মনকে পবিত্রতায় ভরিয়ে দেয়।

লাভা নেওড়াভালি ন্যাশনাল পার্কের পূর্ব সীমান্তঘেঁষা একখানি ছোট পর্যটনকেন্দ্র। এখান থেকে যাওয়া যায় রিশপ, কোলাখাম প্রভৃতি অত্যন্ত জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্রে ।এখান থেকে নেওড়াভালি ন্যাশনাল পার্কের ভিতর দিয়ে ট্রেক করে রাচেলা পাস  অতিক্রম করে পৌঁছানো যায় ঝালং এর কাছে তোদে তে। অসাধারণ সুন্দর রাস্তা,তবে বিপদজনক। তাই কর্তৃপক্ষের অনুমতি  সাপেক্ষে যাওয়া যায়।

গাড়ি এগোল লোলেগাঁও এর উদ্দেশ্যে। রাস্তার দু’ধারে ধুপি আর সাইপ্রাসের জঙ্গল। চোখে পড়ে গুরাস গাছের জঙ্গল আর তার অঙ্গে লাল রডোডেনড্রন গুচ্ছ। রাস্তা যত এগোয় জঙ্গল হয় ততো গভীর। তীব্র ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক। চোখে পড়ে অসংখ্য বাবলার আর নীল রবিন এর ঝাঁক। স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি এমন অকৃত্রিম বুনো সবজে পরিবেশে। শুধু গাড়ির আওয়াজ আর মাঝে মাঝে দীপ্ত দা ও সুদীপ্ দার  খুনসুটি পরিবেশকে করে তোলে কৌতুক ময়। মাঝে সামান্য বাঁক নিয়ে একটু এগিয়ে পৌছালাম গীতদাবলিং।অভিজিতের এক পরিচিত ডাক্তার বন্ধুর কোয়াটারে।

এটি মূলত একটি গ্রাম। চারিদিকে সাদা ও হলুদ প্রিমুলা ফুলের ঝোপ আর রংবেরঙের প্রজাপতি। যারা প্রজাপতি পর্যবেক্ষক তাদের স্বর্গরাজ্য এই গীতদাবলিং ও লোলেগাঁও। সামনে উচু টিলা। তার ওপরে কিছুটা সমতল জমি। সেখানে উঠে দেখলাম খেতি খামারির কাজ করছে গ্রামের মহিলা পুরুষ নির্বিশেষে সকলে।তবে সর্বত্র মহিলারা সংখ্যাগরিষ্ঠ। লাভা থেকে লোলেগাঁও সর্বত্র লেপচা অধ্যুষিত সম্প্রদায়ের বসতি। অন্যান্য পাহাড়ি জাতির মত লেপচা মেয়েরাও অত্যন্ত কর্মঠ। এই  গীত দাবলিং পাহাড়ের ঠিক উল্টো দিকের পাহাড়টাই হলো দার্জিলিং। মাঝে রংগীত নদীর অববাহিকা।

অভিজিতের বন্ধুর সৌজন্যে আমরা লোলেগাঁও এ পেলাম দার্জিলিং গোর্খা হিল কাউন্সিলের চমৎকার রিসোর্টের ঠিকানা এবং বুকিং। বিস্তৃত জায়গা নিয়ে অর্কিড ও ক্যাকটাসের অলংকারে অলংকৃত  রিসোর্টটি  সবুজ গাছগাছালি ভরা একটি খাদের ধারে অবস্থিত। খাদটি রেলিং দিয়ে ঘেরা। রেলিং টির  ধারে ধারে অজস্র ফুলের বাগান।

 

রাতে ঝিমধরা কুয়াশামাখা চুইয়ে পড়া ঠান্ডা জোসনায় রেলিং ধরে জোনাকির মত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আলোক বিন্দুতে আবৃত কালিংপং পাহাড় এক আধিভৌতিক তন্দ্রাচ্ছন্ন  পরিবেশ রচনা করেছে। সেই মায়া বন্ধন কাটিয়ে ওঠা ওই কনকনে ঠান্ডা তেও সম্ভব ছিল না। একটা রাতচোরা পাখি ক্রমাগত শিস দিয়ে যাচ্ছে। রাতের প্রকৃতি তার মোহময় রূপ- গন্ধ -বর্ণ নিয়ে আবৃত করছে আমাদের। দীপ্ত দার আবেগময় কন্ঠে শোনা যাচ্ছে, “প্রান ভরিয়ে তৃষা হরিয়ে মোরে আরো আরো আরো দাও প্রাণ।”

নিঝুম রাতে চাঁদের আলো মেখে স্বর্গের মতো কালিম্পং পাহাড়ের স্থির ছবি আঁকা রয়েছে। শিখরের পর শিখরের ওপর দিয়ে জ্যোৎস্নার ঝর্ণা রুপোলী লহর তুলে বয়ে যাচ্ছে। কোথাও আলো, কোথাও ছায়া।

ঠিক যেন বুকের ভেতর বাঁধন-হারা উচ্ছ্বাস আর চোখের কোণে অশ্রু। ঠান্ডায় চোখের কোনটা মুছে উষ্ণ কম্বলের তলায় আশ্রয় নিলাম।

 পরদিন ভোর রাতে বেরিয়ে পড়লাম ঝান্ডি ধাড়া এ সূর্যোদয় দেখার উদ্দেশ্যে। সাতরঙা রঙের রশ্মির টানে উদয় হবেন মোহময়ী কাঞ্চনজঙ্ঘা। কিন্তু কুয়াশার দাপটে সে আশা পূর্ণ হলো না। তবে ভোরের কুয়াশা মাখা জঙ্গল, পাখিদের কলরবে,ঠান্ডা বাতাসে বুনো গন্ধে আর গাছের পাতা থেকে টুপ টুপ করে ঝরে পড়া শান্তির জলে আমাদের মন প্রশান্তিতে ভরে গেল। রিসোর্টে পৌঁছেই সুদীপ দা কে টর্চ ফেরত দিলাম, যেটা পাওয়ার জন্য আমায় শুনতে হয়েছিল” অর্ণব, তুই কি টর্চ মেরে সূর্যোদয় দেখবি ?”

প্রাতরাশ সেরে চললাম ক্যানোপি ওয়াকে। শ্যাওলা,মস ধরা প্রাচীন ওক, ফার,ধুপিগাছের মধ্য দিয়ে দড়ি বাঁধা রাস্তা যা প্রায় 180 মিটার বিস্তৃত। সুমন ,অভিজিৎ মহাউৎসাহে এগিয়ে চলেছে। লোলেগাঁও এ যেটা সবচেয়ে বেশী মন কাড়ে তা হল প্রাচীনত্ব। কতকালের পুরনো ! কি বিশাল গাছগুলি ! শতাব্দীর পর শতাব্দী কত ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। সকালের নরম রোদ গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে এক আলো-আঁধারির পরিবেশ রচনা করেছে,যেন কোন প্রাচীনকালের স্বর্গের রাস্তা। সময় এখানে থমকে দাঁড়ায়।

তবে সারথি রাজু সময়ে বড় নির্দিষ্ট, অগত্যা এগিয়ে চললাম প্রাচীন নৈশব্দমোড়া  লোলেগাঁও থেকে কালিম্পং এর উদ্দেশ্যে, ঠিক বিপরীত পাহাড়ে। প্রায় দু’ঘণ্টা পর পৌছালাম ডেলো পাহাড়ে। কালিংপং শহরটি  পার্শ্ববর্তী দুইটি পাহাড়ের রিজের  উপর অবস্থিত ।একটি ডেলো ,অন্যটি দুরপিন। তবে 5590 ফুট উচ্চতার  ডেলো এই শহরে সর্বোচ্চ বিন্দু। এখান থেকে পূর্ব দিকে রেলি অববাহিকার বিপরীতে অবস্থিত লোলেগাঁও আর পশ্চিম দিকে তিস্তা  অববাহিকার বিপরীতে পশ্চিম সিকিম দৃশ্যমান। ডেলো পাহাড়ের পার্ক টিও পর্যটকদের জন্য যথেষ্ট আকর্ষণীয়।

এরপর সাঙ্গ হল আমাদের পথ চলা। রাজু বলল এখনো তার ঝুলিতে তাস রয়েছে। এটি হলো আমাদের কে দেওয়া তার উপহার। সেটি আমাদের দৃষ্টিগোচর করেই  আমাদের এনজিপি তে পৌঁছে দেবে।

তাস ফেলল। একেবারে টেক্কা। নিয়ে এলো পাইন ভিউ নার্সারি। এটি একটি ব্যক্তিগত সম্পত্তি। কিছু দক্ষিণার বিনিময় ভিতরে প্রবেশ করে মন প্রাণ জুড়িয়ে গেল। প্রায় পনেরো শত  প্রজাতির, সপ্ত মহাদেশের  বিভিন্ন প্রান্তের ক্যাকটাস আমাদের সামনে দৃশ্যমান। প্রায় চার দশক ধরে মিস্টার মোহন এস প্রধান তার প্যাশন কে  গড়ে তুলেছেন । মাথা নত করা ছাড়া এমন মানুষের সামনে আর কি করা যায়। ইনাদের অন্তর্দৃষ্টি বলেই এত বৈচিত্র্যময় রংবেরঙের অপূর্ব গঠনশৈলীর ক্যাকটাস আমাদের চর্মচক্ষু কে সার্থক করে তোলে। ইনাদের অব্যক্ত পরিশ্রমই পৃথিবী এত সুন্দর ।প্রকৃতি ও মানুষের মাঝে যোগসুত্র হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন এই  প্রকৃতিপ্রেমী মানুষগুলি। আর আমরা এলাম ,দেখলাম, জয় করলাম বলে হারিয়ে যাই  অতল গহবর এ। লোলেগাঁও এর সেই  প্রাচীন ওক  গাছের খসে যাওয়া পাতার মতন। অবশেষে রিম্বি, কালিঝরা, সেভোক তিস্তা ব্রিজ পেরিয়ে মহানন্দা অভয়ারণ্যের মধ্য দিয়ে এসে পৌছালাম শিলিগুড়ি এবং আমাদের গন্তব্য এনজিপি স্টেশনে। 

তুর্কি সফর শেষ। মানসপটে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখা হীরা-মানিক গুলি কে। সকলের চোখে মুখে ঘোরের অভিব্যক্তি।পাহাড় জঙ্গলের অভিঘাত আমাদের কৃত্রিমতা মোরা জীবনকে কি কিছু দোলা দিল ?

এই যাত্রায় অনেক কিছু পাওয়ার মধ্যে পরম পাওয়া অবশ্যই সারথি রাজু। আমার এই অরণ্য গাথার পরবর্তী অংশগুলি যদি পড়েন তবে অবশ্যই আবার আপনাদের সঙ্গে রাজুর দেখা হবে। দেখা হবে পাতাঝরা, কুয়াশা মোড়া, ছায়াময়,জংলি ফুলের গন্ধ ভরা পথপ্রান্তে। এখন ট্রেন এসে গেছে ।পরদিন সকালে পৌঁছতে হবে আমাদের কঠিন পেশাগত ক্ষুন্নিবৃত্তির দরবারে। তবে বন্ধু বিদায়। আবার দেখা হবে পরের দোল পূর্ণিমায়। ভালো থাকবেন ।

                                                                                                                              ক্রমশঃ

1 Comment

Atasibarna Amity. · at

তোমার ‘অরণ্য গাথা’ লেখাটি পড়লাম। খুব ভালো লাগলো।সুন্দরী ডুয়ার্সের প্রতি আকর্ষণ আরো বাড়িয়ে দিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Weekend tour - Romantic Dooars
error: Content is protected !!