চুইখিম – মেঘের চাদর আর পাহাড় দিয়ে ঘেরা
Published by Editor on
চুইখিম – মেঘের চাদর আর পাহাড় দিয়ে ঘেরা
– তড়িৎ কুমার সরকার
আমাদের এবারের ভ্রমণ শুরু হয়েছিল শিয়ালদহ থেকে নিউ জলপাইগুড়ি। সেখান থেকে গাজলডোবা হয়ে গরুবাথান, সেখান থেকে লাভা হয়ে মাইরুন গাঁও। আর শেষ করেছিলাম চুইখাম থেকে বাগড়াকোট হয়ে শিলিগুড়ি। মধ্যে রিশপ, লোলেগাঁও, কোলাখাম, ছাঙ্গে ফলস, চারখোল, সামথার, পানবু, সাংসের, জলসা বাংলো, মাঙ্গেরজং ঘুরে চুইখিমে শেষ। নিউজলপাইগুড়িতে নামার পর কাঞ্চনবাবু সপরিবারে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা করলেন। তারপর কি যে হল গোটা ট্যুরে উনি আমাদের আর দর্শন দিলেন না। তাতে অবশ্য আমরা দুঃখিত নই। এবারের ট্যুরের পরিকল্পনা আমাদের এমন ছিল যে প্রায় ৯ মাস ঘরে বাসে থাকার পর বাইরে বেরিয়ে গ্রামে গঞ্জে পাহাড়ে পর্বতে বনে জংলে শুধু ঘুরে বেড়াব। গা, হাত পায়ের জং ঝাড়াব। সেই অর্থে আমাদের ট্যুর ১০০% সফল। নাই বা সঙ্গ দিল কাঞ্চনবাবু, তাতে আমরা দুঃখিত নই। হয়তো উনি দেখা দিলে ভাল লাগত ব্যস এই পর্যন্ত।
আমি লেখাটা শুরু করলাম শেষ থেকে শেষ করবো প্রথমে গিয়ে। তার একটা বিশেষ কারণ আছে। আসুন দেখি কি সেই কারণ বা কেন শেষ থেকে শুরু।
আমরা চুইখিম পৌঁছেছিলাম নাক বেড় দিয়ে কান ধরার মতন কোরে। চারিদিক ঘুরে চারখোল থেকে ২২ কিমি গিয়ে চুইখিম পৌঁছাই। কিন্তু আপনারা যাবেন কি ভাবে? শিলিগুড়িথেকে ৪০ কিমি বাগড়াকোট। আর সেখান থেকে মাত্র ১০ কিমি চুইখিম। যে কোন শনি রবিবার ঘুরে আসতে পারেন। কিন্তু কেন যাবেন এত জায়গা থাকতে চুইখিমে? আপনি কিগ্রাম দেখতে চান, দেখতে চান গ্রাম্য জীবন? আপনি কি জঙ্গল ঘুরতে চান? আপনি কি কোন উপত্যকার বুকে সূর্যোদয় দেখতে চান বা গ্রামের টিলার উপর থেকে সূর্যাস্ত? আপনি কি প্রাণ ভরা ভালবাসা পেতে চান? সব এক সঙ্গে পাবেন এখানে। শিলিগুড়ির এত সামনে এত সুন্দর এত কিছু পাওয়ার মাঝে শহর জীবনের না পাওয়ার অংশটা খুবই তুচ্ছ মনে হবে এখানে আসলে।
চুইখিম এ আমরা উঠেছিলাম স্বপন গুরুং এর হোম স্টে Maina Manpray তে। স্বপনের বাবা মাকে যে নামে গ্রামেরলোকেরা ডাকে সেই নামে। এখানে আসলে স্বপনের দিদিকে দেখলেআপনার মনে হবে নামটা খুব একটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। যে নামেই ডাকুন এক গাল হাসি নিয়ে আপনার সব দরকারে হাজির। স্বপনের মায়ের রান্নার হাতটিও পরিপাটি। এবার আসুন চুইখিমটা একটু ঘুরে দেখা যাক। আপনি আছেন চুইখিমের শূন্য মাইলের ল্যান্ড মার্কের সামনে। এখান থেকে চোখের সামনে টিলাতে গ্রামের দৃশ্যপট। ধাপ চাষ। তার মাঝে মাঝে গ্রামের বাড়ি ঘর। বাঁদিকের পাহাড় জংলে পরিপূর্ণ। গ্রামের পাদদেশ পর্যন্ত পাকা রাস্তা গ্রামকে ছুঁয়ে চলে গেছে বাগড়াকোট। সেই ঘুর পথে গ্রামে গেলে সময় লাগবে অনেকক্ষণ।এখানে তাড়াতাড়ি পৌঁছাতে গেলে গ্রামের short cut পথ ধরতে হবে। কষ্ট একটু সময় বাঁচবে অনেকখানি। সেই রাস্তায় দুপুরের খাওয়ার পর রওনা দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে উপস্থিত হলাম চুইখিমের পরিচিত প্রবেশ পথ। পাকা রাস্তার উপর দুটি বাড়ির সংযুক্তি করণ এক সরু পায়ে চলা ব্রিজ। এখান থেকে বাঁ দিকে সিঁড়ি পথে উঠে গেছে গ্রামে ঢোকার রাস্তা। কিছুক্ষণ চলার পর রাস্তা দুই দিকে ভাগ হয়ে গেছে। বাঁহাতের রাস্তা চলে গেছে পাইনে ঘেরা পথে এবং যুক্ত হয়েছে বাগডোগরা চুইখিম সড়ক পথে। সোজা রাস্তা চলে গেছে গ্রামের ভেতরে। সুউচ্চ টিলা পর্যন্ত। ডান দিকে গ্রাম বাঁদিকে পাইন ছাওয়া ঢাল এবং দূরের পর্বত শ্রেণী। বহু দূরে দেখা যায় চওড়া ঘিস নদী এবং তার থেকে উৎপন্ন জুরন্তি নদী ঢুকে পড়েছে গ্রামে। এখানে বলে রাখা ভাল গ্রামের মুষ্টিমেয় ৪/৫ জন চাকরিজীবী বাকি সকলের জীবিকা নির্বাহ হয় কৃষির উপর ভিত্তি করে। আদা, এলাচ, ঝাড়ু ও কোদো (এটা গমথেকে ছোট দানার মতন যেটা থেকে আটা তৈরী হয় যা থেকে রুটি তৈরী হয়)। গ্রামের রাস্তা দেখে আমরা আবাক হয়ে গেছি। এখনও পাকা হয়নি তবে চার লেনের মতন চওড়ারাস্তা। বছরের মধ্যে পাকা হয়ে যাবে আশা করি। রাস্তা চলে গেছে টিলার পাদদেশ পর্যন্ত। স্থানীয় লোকের কথায় টিলার মাথা থেকে ভাল সূর্যাস্ত দেখা যায়। সেই মতন টিলা থেকে সূর্যাস্ত দেখব বলে অনেকক্ষণ আপেক্ষা করার পর মেঘের কারনে ভাল সূর্যাস্ত না দেখতে পেলেও যেটা পেলাম তা হল ঘিস নদী থেকে জুরন্তি নদীর গতি পথ আর টিনের তৈরী মন্দিরে পিতলের বুদ্ধ মূর্তি যেখানে নিত্য পূজার চিহ্ন বর্তমান। জানা গেল এখানে বিশাল বৌদ্ধ স্তূপের কাজ চলছে আর রাস্তা তারই পরিকল্পনার অন্তর্গত। এখান থেকে গ্রামটা পাখির চোখে দেখা যায়। ফিরে চললাম হোম স্টের দিকে।
পরদিন সকালে মেঘে মাখা সূর্যোদয় দেখে হোম স্টের মালিক স্বপন গুরুং এর সঙ্গে কথা বলে অনেক কিছু জানতে পারলাম। ও একটা ইস্কুল চালায়। বর্তমানে সেখানে ক্লাস ফাইভথেকে ক্লাস টেন অব্দি পড়ান হয়। ছাত্র ছাত্রী মিলিয়ে ১২৩ জন ঐ ইস্কুলে পড়ে। পড়ুয়ারা আসে কোথা থেকে। আশেপাশের ৬ কিমি থেকে ১৪ কিমি দূরের পাহাড়ি গ্রাম থেকে। এরা লেখা পড়া না করলে বেশির ভাগ জিপের খালাসির কাজ করবে। ইস্কুলে ৬ জন শিক্ষক। ৫০০০ টাকা বেতন পাবে বলে এসে কোন মাসে ১৫০০, কোন মাসে ১,০০০ বা কোন মাসে বেতন পায়ই না। তাও তারা নিষ্ঠার সঙ্গে ছাত্র পড়িয়ে চলেছে। ৬ টা ক্লাস রুম আর সিঙ্গাপুরের ম্যানেজমেন্ট উনিভারসিটি ২টি টয়লেট করে দিয়েছে। রাস্তা তৈরির কাজেজলের লাইন নষ্ট হয়ে যাওয়াতে আর ইস্কুল পর্যন্ত জল নিয়ে যাওয়াতে স্বপন ব্যাস্ত হয়ে পড়ল। আর পাহাড়ের জঙ্গল পথে পাইপ টেনে নিয়ে গিয়ে জলের উৎস মুখের দিকে দলবল রওনা দিল। আমরাও পাইপ অনুসরণ করে জঙ্গলের পথ ধরলাম। প্রায় তিন কিমি যাবার পরে স্থানীয়রা আর আমাদের এগোতেদিল না গভীর জঙ্গলে বিপদের সম্ভাবনা বেশিবলে। কিছুটা এগিয়ে আমাদের পাকা রাস্তা ধরিয়ে দিয়ে ওরা জঙ্গলের পথে ফিরে গেল আর আমরা পাকা রাস্তা ধরে ফিরে এলাম হোম স্টেতে। এখানে আর একটা জায়গা আছে। নামইয়েলবং। চুইখিম থেকে ৫ কিমি। বাগড়াকোট যাবার পথে প্তহ নেমে গেছে নীচের দিকে। ওখানে জলে পূর্ণ একটি গুহা আছে। উৎসাহী বা অ্যাডভেঞ্চার প্রিয় মানুষেরা ট্রেক করে গুহারভেতর থেকে ঘুরে আসতে পারেন। বেশির ভাগ লোক নাকি ২ কিমি যাবার পর আর যেতে ভরসা পায়নি। সময় আভাবে আমরাও যাই নি। গাড়ি পথে কিছুটা গিয়ে বাকিটা আপনাকেহেঁটে যেতে হবে।
৮ তারিখে আমাদের ফেরার দিন বন্ধ ঘোষণা করা হয়ে ছিল। স্বপন আমাদের সঙ্গে শিলিগুড়ি এল আমাদের ফেরা নিশ্চিত করতে। গাড়িতেই ওর কাছে জানলাম আমরা যে পথেগিয়ে ছিলাম সেখানে ওরা অর্থাৎ গ্রামবাসিরা মিলে সানরাইজ পয়েন্ট তৈরি করছে। গ্রামে কোন মোবাইল টাওয়ার বসাতে দেয় নি সকলের ক্ষতি হবে বলে। ফ্রেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল মাস পর্যন্ত জঙ্গলে গ্রেট হর্ন বিল আর গ্রীন ধুকুর (ওদের ভাষায়) যথেষ্ট পরিমাণে দেখতে পাওয়া যায়। ওকে চিন্তিত শোনাল কারণ যিনি পাইপ দিয়ে ছিলেন ইস্কুল অব্দি জল আনতে সেই পাইপ কম পড়েছে। তার ব্যবস্থা কি করে করবে। খাওয়াস, রাই, সুব্বা, মুখিয়া জাতি অধ্যুষিত শেরওয়ানি, ইয়ং মাকুম, ফাংতার, চুনাভাটি প্রভৃতি দূরদূরান্ত গ্রাম থেকে যে সব বাচ্চারা পড়তে আসছে তাদের মুখে কিছু অন্ন তুলে দেবার ইচ্ছা থাকলেও উপায় বের করতে পারছে না এটাও ওকে কষ্ট দিচ্ছে। সিঙ্গাপুরের ম্যানেজমেন্ট উনিভারসিটি যদি এদের পাশে দাঁড়াতে পারে তবে আসুন না আমরাও চেষ্টা করে দেখি এদের পাশে দাঁড়াতে পারি কি না। সকলকে অনুরোধ করবো যান শিলিগুড়ির এত সামনেএক নিখাদ গ্রাম্য জীবনের স্বাদ নিন। ওর হোম স্টেতে থাকার সহজ উপায় “ফ্যানটাসি হলিডেস এর বাঘা যতীন শাখার শুভ (৭৫৮৫৮ ৩৬২৭৫) এর সঙ্গে নিশ্চিন্তে যোগাযোগ করুন। তারপর সব দায়িত্ব ওর। শুভ কে ধন্যবাদ এমন একটা জায়গার সন্ধান দেবার জন্য। দায়িত্ববান শুভ সম্বন্ধে বলি আমাদের ট্যুরের সময় ওর শশুর মশাই মারা যান। তার পরেও প্রতিদিন নিয়ম করে আমাদের অসুবিধার খবরই শুধু নেয় নি তা দূর করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। এবার বলি এর সঙ্গে ঘুরে নিন মাইরূংগাঁও, চারখোল, কোলাখাম, ছাঙ্গে ফলস, রিকিসুমু, সাংসের, জলসা বাংলো, মাঙ্গেরজং, পুনবু ইত্যাদি। সেই গল্প বলবো এক এক করে এক একটি পর্বে। আজ এখানেই শেষ করলাম। ঘুরতে গেলে ভাল থাকতে হবে আর তাই সাবধানতা বজায় রাখুন।
1 Comment
কৃষ্ণকলি বসু · at
ঘরের কাছে এত সুন্দর একটা জায়গা আছে জানতাম না তো।ধন্যবাদ খুঁজে দেওয়ার জন্য।