মদমহেশ্বর – স্বর্গীয় এক যাত্রাপথ
Published by Editor on
মদমহেশ্বর - স্বর্গীয় এক যাত্রাপথ
– সুমন্ত মিশ্র
মদমহেশ্বর যাত্রার উদ্দেশ্যে বিকেল ৫টায় রঁসিতে যখন বাস থেকে নামলাম তখনও বেশ আলো আছে, এখান থেকে গৌন্দার ৬কিমি, – পুরোটাই শুনেছি উৎরাই, মনেমনে হিসেব কষে দেখলাম ১ঘন্টার পথ, – তাই দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট না করে হাঁটা লাগালাম। মিনিট ১৫ হাঁটতেই পাহাড়ের বাঁকে রঁসি হারিয়ে গেল, পথ এবার গভীর জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, বাস থেকে নেমে যে দু’জন সহযাত্রী আমার সাথে পা-বাড়িয়েছিলেন তাঁরাও বেশ কিছুটা এগিয়ে গেছেন, এখন এই জঙ্গুলে পাহাড়ি পথে একা একা পথচলা।
মদমহেশ্বর গঙ্গার বহমান আওয়াজের সাথেই মিশে যাচ্ছে ঝিঁঝিঁদের একটানা শব্দ, -যেন মোহনবাগান গ্যালারি জুড়ে সব দর্শক একসাথে গোলের বাঁশি বাজাচ্ছে! -মাঝেমাঝেই তার সাথে জুড়ে যাচ্ছে পাখিদের নীড়ে ফেরার শিস্! – শব্দের মরিচিকার মত কানে আসছে টুং টাং শব্দ, – বিশ্বাস করতে ভাল লাগছে আমি একা নই, রাস্তায় অনেকে আছে! – একটানা নীচে নামতে নামতেই বার কয়েক চড়াই ভাঙ্গা, -বুকে হাঁফ ধরলেও ভালোলাগে, -একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি। অন্ধকার নামল, -পথ চলছিই! – সবচেয়ে বাজে হল কোনো আন্দাজই পাচ্ছি না কতদুর এলাম বা আর কতদুরইবা যেতে হবে! এমনি করেই এক চড়াই-এর মাথায় উঠে মিলল এক দেবস্থান, -ভালকরে লক্ষ্য করে বুঝলাম ওটা একটা শ্মশান! বুকে বল পেলাম, – শ্মশান মানে কাছাকাছি লোকালয় থাকার ইঙ্গিত! আরও মিনিট দশেক চলে এক বাঁকের মুখেই দেখা মিলল, – গৌন্দার গ্রাম। মোবাইলে সময় দেখলাম ৬-১০মি ।
গ্রামে ঢোকার মুখেই বাঁদিকে একটা দোতলা বাড়ী, ঠিক তার মুখোমুখি রাস্তার ডানদিকে একটা ছোট্ট ঘর, – ঠাসাঠাসি ভিড়, ভিতরে উনুনে কাঠের গনগনে আঁচ, -বুঝতে অসুবিধা হয়না বাঁদিকের বাড়ীর এটাই কিচেন-কাম্-ডাইনিং রুম । ভিতর থেকে আমাকে উদ্দেশ্য করে আওয়াজ ভেসে এল, – ‘আও দাদা চায় পিও’! ভীড়ে বরাবরই আমার এ্যলার্জি, তাই উত্তর না দিয়ে এগিয়ে গেলাম । ক’পা এগিয়েই আরও একটি অমন রান্নাঘর, -এরও ভিতরে একইরকম ভিড়, – থমকে দাঁড়ালাম, অন্ধকারে রাস্তায় কোনো বয়স্ক মহিলা এগিয়ে আসছেন মনে হল ! – কাছে আসতেই জিজ্ঞেস করলাম, -‘ইঁহা কৈ রেহেনে খানে কি জা’গা মিলেগা মা’জি’ ? – হাঁ হাঁ কিঁউ নেহি, -বলে ঐ মহিলা সামনের রান্নাঘরে উঁকি দিয়ে নিজের ভাষায় কিছু বলতেই ভিতর থেকে প্রায় দৌড়ে এক ভদ্র্মহিলা বেরিয়ে এলেন, – ‘রেহেনা হ্যায়’ – আমার দিকে তাকিয়ে বলতেই ঘাড় নাড়লাম, – পেরিয়ে আসা বাড়ীটি দেখিয়ে বললেন, – ‘উঁহা নেহি মিলা’! আমি একটু বিরক্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করলাম –“রেহেনেকি জা’গা স্রেফ উধারই হ্যায় ক্যায়া ?” – মহিলা একটু ইতস্তত করে বললেন, “হামারি ইধার আজ ভিড় হ্যায়”, – বলতে বলতেই রান্নাঘরের পাশেই একটি বন্ধ দরজা ধাক্কা দিয়ে খুললেন, ভিতরে টর্চের আলো ফেলে বললেন, “দেখিয়ে তো, ইয়ে চ্যালেগা ?” টর্চের আলোয় যা দেখলাম, – মাঝারি মাপের ঘরটিতে পুরোটাই তক্তাপোষ পাতা, দেওয়াল জুড়ে জামাকাপড় ঝোলান, – না চলার মতো কিছু নেই, কিন্তু এতবড় ঘরে শুধু আমাকেই থাকতে দেবে, নাকি আরও অন্য কেউ থাকবে! – আশঙ্কাটা ব্যাক্ত করতেই মহিলা বললেন, – নেহি নেহি স্রেফ আপ-ই রেহেনা! – থাকার সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়তেই ঐ দিদি দৌড়ে চলে গেলেন, – কিছুক্ষণের মধ্যেই নতুন চাদর আর কম্বল নিয়ে এসে আমাকে বললেন, – আপ কাপড়া চেঞ্জ করলো, ম্যায় চা’য় লাতি হুঁ।
ঘামে ভেজা জামাকাপড় বদলে উঠতেই দরজায় টোকা, – সাব্ চা-য়! দরজা খুলতেই দেখি এক হাতে জলের জগ্ আর অন্য হাতে চায়ের গেলাস হাতে দিদি দাঁড়িয়ে! বললেন – পহেলে থোড়া পানি ভি পিলো, উসকে বাদ চায় পিনা! যথা আজ্ঞা! হাত বাড়িয়ে দুটোই নিয়ে হুকুম পালন! চায়ের গেলাসে শেষ চুমুক দিতে না দিতেই আবার হাজির, – “সাব্ থোড়া বাহার কুর্সিমে বইঠো, বিস্তর লাগা দেতি হুঁ”। আমি বাইরে বেরিয়ে মোবাইলে মনোযোগ দিলাম, -বাড়িতে একটা খবর দিয়ে দি, কাল ‘টাওয়ার’ পাব, না পাব! – অনেক কষ্টে দিদিকে ফোনে পেয়ে বলে দিলাম মাকে খবরটা দিয়ে দিতে। নিশ্চিন্ত মনে ঘরে ফিরে দেখি মোমবাতি জ্বলছে, -মোমের আলোয় নরম বিছানার আশ্রয় সারাদিনের দুর্ভোগ ভুলিয়ে দিল! –আগামীকাল ওপরে যাওয়া, তাই প্রয়োজোনীয় জীনিসপত্র স্যাক্ থেকে বার করে একটা ছোট ন্যাপস্যাকে গুছিয়ে নিলাম, -বড় স্যাক্ এখানে রেখেই উঠব।
দরজার বাইরে লোকজনের যাতায়াতের আওয়াজ, হঠাৎ বাংলা কন্ঠ, – “আজ খুব পরিশ্রম হয়ে গেল, কাল সকালে এই জায়গাটার ভালোকরে ছবি নিতে হবে বুঝলি”! অন্য কন্ঠে সন্মতি! শুনে ভালো লাগলো, আমার দেশোয়ালিও কেউ কেউ আছেন এখানে ! চমকে দিয়ে দরজা খুলে একটি সুন্দরী কিশোরী, – আপকো উও কিচেন মে বুলা রহি হ্যায়! পরিস্কার বাংলায় উত্তর দিলাম ‘চলো যাচ্ছি’, কি বুঝল জানিনা, তবে চলে গেল!
রাত্রি ৯টার মধ্যেই খাওয়া সেরে শুয়ে পড়লাম। সকাল ৭টায় ‘জয় মদমহেশ্বর’ বলে রওনা! – ১২কিলোমিটার রাস্তা, যত চড়াই-ই হোক আশাকরি ৫ঘন্টায় পৌঁছে যাব! – আসলে বেশীরভাগ রাস্তটাইতো ১০,০০০ফুটের নীচে, তাই কষ্ট তেমন হওয়ার কথা নয়, -মনে মনে এসব হিসেবনিকেষ করতে করতেই কখন ঘুমিয়ে পড়েছি! মোবাইলের অ্যালার্মের আওয়াজে ঘুম ভাঙল, -সাড়ে ৫টা। বাঁদরটুপি মাথায় গলিয়ে, ব্রাশ নিয়ে বাইরে এলাম, – পাহাড়ের নিত্য অভ্যাস, – সকালে উঠেই আকাশের দিকে চাওয়া, – সেখানে এখনও তারাদের ঝকঝকে উপস্থিতি! আশ্বস্ত হলাম, – সকালের পথটুকু অন্তত সূর্যকে সঙ্গী পাওয়া যাবে! ব্রাশকরে, প্রাতঃকৃত্য সেরে ঘরে ঢোকার মুখেই দিদির গলার আওয়াজ পাই, – চা-য় লাউঁ দাদা? ‘হ্যাঁ’, বলেই ঘরে ঢুকে টুকিটাকি জীনিসপত্র মিলিয়ে নিই, তৈরী হয়ে নিই দ্রুত।
চা খেয়ে ডি৯০হাতে বাইরে বেরোলাম, -কাল যখন আসি তখন গাঢ় অন্ধকার, সকালের স্নিগ্ধ আলোয় সেই গৌন্দার-ই আজ নানা রঙে রঙীন! দিদির রান্নাঘরে ভীড়, সেখানে এখন ‘সাহেব’দের ‘ব্রেকফাস্ট’-এর প্রস্তুতি, – আমিও অর্ডার দিয়ে দিয়েছি, – রুটি এবং ডাল। পায়চারি করতে করতেই আলাপ হল বাঙালী ভদ্রলোকদের সাথে, -ওঁরা কাল মদমহেশ্বর থেকে ফিরেছেন, আজ ফিরবেন উখিমঠ। কিছুটা যেচেই আলাপ জমিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, ভাই ওপরের রাস্তা কেমন! উত্তর পেলাম, “এতটা এসেছেন, যেমন দেখেছেন তেমনই”! বললাম, আন্দাজ কতক্ষণ লাগতে পারে ? – “সেটা কি করে বলব, যেমন চলবেন তেমনই”! কিছুটা অপ্রস্তুত হয়েই বলি, – সেটা ঠিক, তবে আপনাদের কতক্ষণ লেগেছিল ? বললেন, “আরে আমরা খুব আস্তে হেঁটেছি”, বললাম – তাও, – “দেখুন আমরা ৮টায় বেরিয়েছিলাম, পৌঁছেছি বিকেল ৫টায়”, – আমার মুখ দিয়ে অজান্তেই ‘এ্যাঁ’ বেরিয়ে যায়! দলের যিনি হোতা তিনি আমায় জিজ্ঞেস করেন, “আপনি ক’টায় বেরোবেন”? ৭টা – সাড়ে৭টা ভেবেছি, বলতেই বললেন, – “সাড়ে৩টে – ৪টের আগে পৌঁছতে পারবেন না, মনে রাখবেন আমরা কিন্তু ‘আপার বানতোলি’ থেকে হাঁটা শুরু করেছিলাম”! আমি দূরের গ্রামের দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললাম – ঐতো বানতোলি! বললেন, -“আরে ওখান থেকে আপার বানতোলি আরও ৪০মিনিটের পথ”! – সব কেমন গুলিয়ে যেতে থাকল, সাতপাঁচ না ভেবে ওদের কাছে বিদায় নিয়ে সোজা রান্নাঘর, – গরম গরম ডাল-রুটি খেয়ে, দিদির জিন্মায় স্যাক রেখে পা বাড়ালাম –‘জয় মদমহেশ্বর’! ঘড়িতে সাড়ে ৭টা!
মদমহেশ্বর গঙ্গাকে ডানদিকে রেখে পাহাড়ের কোল ঘেঁষে পাথুরে পথ, – বানতোলি পর্য্যন্ত উৎরাই। নদীর ওপারের পাহাড়গুলো বেশ লম্বা-চওড়া হওয়ায় রোদের নাগাল পেতে যে এখনও কিছুটা দেরি – বুঝতে পারি! মিনিট২০ যেতেই ছোট্ট একটা ব্রীজ পেরিয়ে বানতোলি, দুই নদীর মিলনস্থল – সরস্বতী ও সুমেরু গঙ্গা, – এই মিলিত ধারাই মদমহেশ্বর গঙ্গা, এখানে ৪-৫টি বসতি, – প্রত্যেকের ঘরেই দোকান, -তাদের চা-পানের আমন্ত্রণ উপেক্ষা করেই এগিয়ে গেলাম। – এখান থেকে রাস্তা পুরোটাই খাড়াই। পাহাড়ি রাস্তায় ধীরপায়ে পাক্ খেতে খেতেই আরও মিনিট ১৫ পর উঠে এলাম আপার বানতোলি! সকালে আলাপ বাঙালী ভাইদের কথা মনে পড়ল, মনে পড়ল জংরি এবং হেমকুন্ড সাহেবের পথে এরমই কিছু বাঙালী পর্যটকের কথা! – অন্যকে বিভ্রান্ত করাতেই যাদের পথ চলার আনন্দ।
পথ নিরিবিলি, বড় বড় গাছের ছায়ায় ঘেরা পাহাড়ি রাস্তা ধরে চলেছি, চলেছি প্রকৃতির নির্জন অন্তঃপুরে! একজন-দু’জন আমাকে টপকে এগিয়ে যান, -এঁরা সবাই ঐ বিদেশী দলটির সদস্য। এক পা এক পা করে এগোনো, -হঠাৎ মাথার উপর থেকে ভেসে আসে – “দাদা আপ মস্ত্ চলতে হো”! থমকে ওপর দিকে তাকাই, -দেখি হাসিহাসি মুখে জর্জিয়ান দলের পোর্টার ছেলেটি পাকদন্ডি পথের উপরে দাঁড়িয়ে আমার দিকেই চেয়ে আছে! বলি, -ভাইয়া ২০সালসে ম্যায় আ্যয়সা হি চলতে হ্যাঁ, কিঁউ, সহি নেহি হ্যায় ক্যায়া ? ‘পূরন’(পরে জেনেছিলাম ওর নাম) বলল, -“নেহি স্যার, ম্যায় নীচেসে আপকো ফলো কর রাহা হুঁ, সাচমুচ আপ বহুৎ আচ্ছে চলতে হ্যাঁ”। মনে বল পেলাম, মাত্র দু’বছর হল আ্যকসিডেন্টে পা-কাঁধ ভেঙ্গে উঠেছি, তাও এবার এসেছি একেবারে একা, – পূরনের কথায় আত্মবিশ্বাস বাড়ল সন্দেহ নেই! ১ঘন্টার আগেই ‘খাদাড়া’ পৌঁছলাম। দু’ঘর মানুষের গ্রাম এই খাদাড়া! পাহাড়ি পথে পানিয়ই শক্তি, – তাই চায়ের ফরমায়েশ করে চেয়ে রইলাম তুষারমৌলি হিমালয়ের দিকে! – স্পর্শ পেলাম প্রথম সূর্য কিরণের, পরিচয় হল পূরনের দলের গাইড কুন্দনের সাথেও! মিনিট পাঁচেকের বিশ্রাম, আবার পথচলা, শ্যামলী পাহাড়ের মাথায় নীল আকাশের ঘোমটা, -সকালের নরম রোদ্দুরে রূপ যেন ফেটে পড়ছে! – গলায় ঝোলানো ক্যামেরায় হাত পড়ে! – পর পর বেশ কিছু ছবি নিই, -আবার চড়াই ভাঙ্গা! এখানে জঙ্গল কিছুটা পাতলা, রোদ-ছায়া মেশানো পথে পাখিদের হরেক রকম ডাক শুনতে শুনতে এগিয়ে চলা! মাঝেমাঝে পাথর ভাঙ্গার শব্দ, – জায়গায় জায়গায় রাস্তা মেরামতির কাজ চলছে, – একে একে পেরিয়ে আসি নানু, মৌখম, কুন, – ঘড়িতে সাড়ে ১১টা! ঘন জঙ্গলে ঢাকা পথে নতুন মূর্তিমান উৎপাত শ্রীনগরের(গাড়োয়াল) ছাত্রছাত্রীদের একটি দল! লাউডস্পিকারে গান বাজিয়ে, নেচে, হল্লা করে শিবভূমির শান্তি মাথায় উঠিয়েছে! বিরক্ত হয়েই চলার গতি বাড়াই, বেলা পৌনে১২টা নাগাদ উঠে আসি শিবঠাকুরের আপন দেশ, – মদমহেশ্বর উপত্যকায়।
ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি, ওঁ শান্তি’ – চারদিকে নিরুচ্চারে যেন এই বাণীই ধ্বনিত হচ্ছে, – অপূর্ব, মন ভরে গেল –‘পুণ্য হল অঙ্গ মম, ধন্য হল অন্তর!’ রাস্তার বাঁদিকে বোর্ডে উচ্চতা লেখা ৩২৮৯ মিটার! বিস্তীর্ণ সবুজ উপত্যকা, – মাথার ওপর পরিস্কার নীল আকাশ, – ডানদিকে তুষার শোভিত হিমালয়, – বাঁপ্রান্তে ‘বুড়া’র খাড়া দেয়াল আর সামনে দেবাদিদেবের গর্ভগৃহ। -পৌঁছে গেছি পঞ্চকেদারের এক কেদার, – মদমহেশ্বর! মিনিট৫ চলতেই পর পর গুটি-কয়েক থাকবার চটি! – বাঁদিকের রাস্তার ঢালে প্রথম চটিতেই কুন্দন চেয়ার পেতে বসে, – আমাকে দেখেই বলে – “ক্যায়া দাদা বোলেথে না, আপ ১২বাজে কি পহেলেহি পৌঁছ যায়েঙ্গে!” – ঘড়ি দেখি – ১২টা বাজতে ১০ মিনিট বাকি। পাথর কাটা ধাপে নেমে এসে বসি কুন্দনের পাশে। হোটেলের মালিক প্রৌঢ় ভদ্রলোক হাতজোড় করে এগিয়ে আসেন, বলেন, – “দাদা আপকে বারে মে ইয়েলোগ (কুন্দন কে দেখিয়ে) বোলা, মেরে পাস দো রুম হ্যায়, -পহেলে ফোরেনার লোগোকো চয়েস করনে দিজিয়ে, উসকে বাদ আপকো কামরা দেঙ্গে, আপ আরাম সে ধুপমে বৈঠো!” প্রকৃতির উদারতা মনের উপর ছাপ ফেলল কিনা জানিনা, -ওঁকে বললাম – মেরেকো রাতকো শোনে কে লিয়ে থোড়াসা জা’গা দেদেনা, উস্সেই চলেগা।
শিরশিরে হাওয়া দিচ্ছে, ঘামে ভেজা জামাকাপড় পাল্টিয়ে রোদে বসি কুন্দনের পাশে। রান্নাঘরের সামনেই এক প্রৌঢ়া আটা মাখায় ব্যস্ত, – আমি তাঁকে উদ্দেশ্য করে বলি, – দিদি আজ বড়িয়া খানা বানানা, আপকি হাতকি বানায়ি হুয়ি রোটি বহুৎ দিন ইয়াদ আনা চাহিয়ে! দিদি ঈষৎ হেসে ঘাড় হেলান! – কিন্তু আমার এই কথা ক’টায় যে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ধুন্ধুমার বাধতে পারে তা ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করিনি! বেশ কিছুক্ষণ নিজেদের মধ্যে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর শিবানন্দজি (হোটেল মালিক, পুরোনাম – শিবানন্দ পানওয়ার) আমার কাছে এসে বলেন, -“এক বাত্ হ্যায় দাদা, -আপ ইধার রেহেঙ্গে, লেকিন খানা খানে হোঙ্গে মন্দির কি পাস যো হোটেল হ্যায় উসমে।“ – কুন্দনের দিকে তাকিয়ে বলেন, -“ইয়ে লোগোকো ভি উধার-ই খানা পড়েগা, ম্যায় স্রেফ ফোরেনার লোগোকো খানা খিলায়েঙ্গে”! এতক্ষণে মালুম হয় বচসার কারণ! -আমাদের অপরাধ জানতে চাই! – বলেন, -“ক্যায়া বাতায়ুঁ দাদা, ইঁহা ‘ইউনিয়ন’ হ্যায়, মন্দির কমিটি বালে নে ইয়ে ঠিক করতে হ্যায়, – কৌন কাঁহা খানা খায়েঙ্গে!” – শুনে হাড় হিম করা শীতেও মাথা গরম হয়, বলি – আমি এখানেই খাব, তারপর ইউনিয়ন কিছু বললে আপনি আমায় বলবেন! বেচারি নেহাতই ভালো মানুষ, ভয়ে মুখ শুকিয়ে যায়, আমায় বারবার বোঝাতে থাকেন নিজের অসহায়তার কথা! ওনাকে বলি, – এই ‘ইউনিয়ন’ যে মানুষের কত বড় সর্বনাশ করতে পারে তার জলজ্যান্ত উদাহরণ আমাদের বাঙালি জাতি! যেখানে শিক্ষার সমবন্টন নেই সেখানে ‘ইউনিয়ন’ শব্দটা যে শুধুমাত্র ক্ষমতাবান কিছু লোকের স্বার্থ সিদ্ধি করে থাকে, বাকি সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয় – এটা আমাদের চেয়ে ভালো কেউ জানেনা! শিবানন্দজি আমার সাথে সহমত পোষন করেও নিজের অসহায়তা ব্যক্ত করেন! অগত্যা সের’মই ঠিক হয়।
দুপুরের পর থেকে চারিদিক মেঘে ঢেকে গেল। বুড়ামদমহেশ্বর দর্শণ আগামীকালের জন্য তোলা রেখে দুপুরের আড্ডা জমলো ‘আশুতোষ ট্যুরিস্ট হোটেলে’-এর রান্নাঘরে! কথায় কথায় কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে, -কে বলবে আমাদের আলাপ মাত্র কয়েক ঘন্টার! মন্দিরে ৬টার ঘন্টা বাজতেই পূজোর ডালা নিয়ে পৌঁছে গেলাম সন্ধ্যারতি দর্শণে! – অবাক হলাম জর্জিয়ান দলটির নিষ্ঠা ও ভক্তি দেখে, – সারিবদ্ধ ভাবে হাতজোড় করে মন্দির প্রঙ্গণে উপস্থিত! – লজ্জাবোধ হল আমার দেশেরই কিছু লোকের জন্য, – যাঁরা অকারণে এঁদের সাথে দুর্ব্যবহারে উদ্যত হলেন! প্রতিবাদ করলাম, -প্রধান পুরোহিতের হস্তক্ষেপে সমস্যা মিটল! ১ঘন্টার আরতি যতই ‘স্তবের বাণীর আড়াল’-এ থাক, ভক্তের সরল প্রাণে নিরব হয়ে ডাকায় তাতে ছেদ পড়ল না এতটুকু! পূজো সেরে, রাতের খাবার খেয়ে রাত ৮টাতেই স্লিপিং ব্যাগে ঢুকলাম।
৫টায় অ্যালার্ম বাজলো, -উইন্ডচিটার-টুপি গলিয়ে বাইরে এলাম, কনকনে ঠান্ডা, -সারাটা ঊপত্যকা যেন নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে আছে তারাদের উজ্জ্বল পাহারায়! আমি প্রস্তুত হই, -প্রস্তুতি বুড়ামদমহেশ্বর দর্শণের! ঠিক ৬টায় মন্দিরের পিছনের রাস্তা ধরে উঠতে আরম্ভ করলাম, – আধঘন্টা উঠতেই নজরে এল কাঙ্খিত ‘চৌখাম্বা’র! – ‘একি এ সুন্দর শোভা’ -চৌখাম্বার মাথায় প্রথম সূর্যকিরণের চুম্বন! – দ্বিগুন উৎসাহে বাকি পথটুকু শেষ হতে লাগলো আরও ৩০মিনিট। -উচ্চতা ১১,৪৭৩ফুট – সব পরিশ্রম যেন উবে গেল! সর্বাঙ্গ আনন্দে মাখামাখি হয়ে হোটেলে যখন ফিরলাম, – ঘড়িতে সকাল সোয়া৮টা। নেমে যাব আজই, -গৌন্দার। জলখাবার খেয়ে সবকিছু গুছিয়ে শিবানন্দজির কাছে গেলাম পাওনাগন্ডা মেটাতে! অবাক কান্ড! – বারবার বলেন, -“আপসে কুছ নেহি লেপায়েঙ্গে দাদা, কুছ নেহি দেনা, ফির্ আনা!” – জলেভরা চোখ, রান্নাঘরের দরজায় দাঁড়ানো দিদির দু’গালেও জলের ধারা, – আমারও কি দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে! – না আর দেরী করব না, -নিজের মনেমনে একটা হিসেব করে টাকাগুলো গুঁজে দিলাম শিবানন্দজির পকেটে, দু’হাতে জড়িয়ে নিলেন বুকে! অস্ফুটে কিছু কথা, – পৌঁছলোইনা কানে! স্যাক পিঠে হাঁটা দিলাম।
হিমালয়ের পথে পথে এই ভালোবাসাই পথ চলিয়েছে বারবার, – ফিরতে ফিরতে শুধু একটাই প্রশ্ন আসে মনে, লোকে যে বলে জন্ম জন্মান্তরের ভালোবাসা – এটা তবে কি! মাত্র একবেলার অতিথিকেও এই মায়াবন্ধনে জড়ানোর ক্ষমতা যে শুধু হিমালয়েরই আছে।
1 Comment
Shipra · at
Asadharon laglo..ami 8th July 2023 gangotri to gomukh yatra start kori 9th July fire asi.
Mahadev er hat amr mathay chhilo tai bari firte perechhi aboseseh a.
River pool venge gachhe. Sange landslides.
Vebechhilam gangotri te ase mone hoy beche gelam
Na..rastay gangotri to Uttarkashi
Uttarkashi to deheradun puro landslides.
11th July 2023 deheradun airport e ase hanuman ji o siv ji e dhonnobad dilam j ami beche gechhi.
Jay sivasomvu…