জব্বলপুর – কানহা

Published by Editor on

জঙ্গল

জব্বলপুর – কানহা

– সুমন্ত মিশ্র

ঠ্যাং ভেঙ্গে চারমাস বাড়ীতে বসে থেকে বেড়ানোর মনটাও ভেঙ্গে চুরমার! আবার কবে পাহাড়ে যাব, আদৌ আর যেতে পারব কিনা – এই সব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই মা বলল – “২৬শে জানুয়ারির সময় লিপি’র ক’দিন ইস্কুল ছুটি আছে, চ’না কোথাও ঘুরে আসি”। ঈশ্বর মঙ্গলময় কিনা জানিনা, তবে মা যে সদা মঙ্গলময় আবার টের পেলাম! এতটুকু সময় নষ্ট না করে দিদির সাথে ফোনে কথাবলে নিই, – পছন্দের জায়গা – গোপালপুর, ওড়িশা। সঙ্গে সঙ্গে লেগে যাই টিকিটের খোঁজে – বিধি বাম! কোনোদিক থেকে কোনোভাবেই যাওয়া বা আসার কোনো টিকিট নেই! অগত্যা আমার ওপর-ই ভার পড়ল স্থান নির্বাচন ও টিকিটের ব্যবস্থার। ভাবলাম মধ্যপ্রদেশ কেমন হয়! কিন্তু এত বড় রাজ্য, ৫-৬দিনে কি ঘুরব! ভাবনাটা দিদিকে জানাতেই, – বলল, “চ’না জব্বলপুর ঘুরে আসি, মার্বেলরকস্ যাবার ইচ্ছে অনেক দিনের”। মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের ওয়েবসাইট ঘাঁটতেই দেখি কানহা থেকে জব্বলপুর এর দূরত্ব ১৬০কিমি – মানে জব্বলপুর গেলে কনহার জঙ্গল সাফারিও সেরে নেওয়া যায়! রেলের ওয়েবসাইটের তথ্যও জানাল টিকিট পাওয়া যাবে – সেইমত যাওয়া-আসার চারজনের টিকিট হল – মা, দিদি, লিপি(আমার বোন) ও আমার।

২২শে জানুয়ারি বিকেলে শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেসে রওনা। ৩নং প্ল্যাটফর্মে ট্রেনটা ঢুকতেই একটা অদ্ভুত আনন্দে মনটা ভরে গেল! খুবজোরে চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে করছিল – আমি আবার বেড়াতে যাচ্ছি-ই! বাইরে জাঁকিয়ে শীত, কামরায় টের পাবার যো নেই! আশ্বস্ত হওয়া গেল – মা-এর তেমন কষ্ট হবেনা। কিন্তু এ কি – চারজনের ৪টে লাগেজ রাখার-ই যে জায়গা নেই! ওপর থেকে নিচ অবধি মালপত্রে ঠাসা, বুঝলাম এসি টিকিটের আড়ালে এটাই হালফিলের প্র্যাকটিস! বাধ্য হলাম গলার স্বর চড়াতে, ফলও পেলাম হাতেনাতে। ‘ফোঁস’ এর আশ্রয় নিতেই সহযাত্রীদেরও ‘হোঁশ’ ফিরতে বিলম্ব হল না, আসানসোল পেরোতে না পেরোতেই আলাপ জমে উঠল। সকলেরই গন্তব্য জব্বলপুর – আামরা ট্যুরিস্ট আর ওনারা ওখানেরই বাসিন্দা।

পরদিন সকালে চা খেয়ে নিজের বাঙ্ক ছেড়ে নিচে নামতেই দেখলাম বাইরে ঘণ কুয়াশা, ট্রেনও চলছে ঢিমেতালে। – এখনই আড়াই ঘন্টা লেট্। সিংরৌলি পেরোতে ছায়াছায়া রোদ উঠল, দরজা ঠেলে বাইরে গেলাম – ঘণ শালের জঙ্গল, উঁচুনিচু জমি, মাঝেমাঝে পলাশের উঁকি – রাঢ় বাঙলার জলহাওয়ায় বেড়ে ওঠা মন প্রথম দর্শনেই প্রেমে পড়ল মধ্যপ্রদেশ মালভূমির! মাইলের পর মাইল রুক্ষ শুস্ক প্রান্তর আর ঘণ জঙ্গলের বিস্তৃতি বোঝাল কেন সে ছিল বছরের পর বছর দুদ্ধর্ষ ডাকাত দলের প্রিয় চারণভূমি! মধ্যে মধ্যে দু-চারটে বাড়ী, সামনের জমিতে অড়হর কিংবা সরষে চাষ, আবার ঘন জঙ্গল। বেলা বাড়ছে, দুপুরে মায়ের বানানো লুচি- তরকারি খেয়ে আবার এক ঘুম – ভাঙল “চা-আ-য়, চায়-গরম্” আওয়াজে। ট্রেন দাঁড়িয়ে আছে, লেট্ এখন সাড়ে তিন ঘন্টা! বাইরে উঁকি দিয়ে দেখি ‘কাটনি’ স্টেশন – মানে এখনও পৌনে দু ঘন্টার জার্নি! হোটেলে ফোন করে সময়মত গাড়ী পাঠানোর অনুরোধ জানিয়ে সবাইমিলে খোশ গল্পে মাতলাম। সন্ধ্যে সোয়াসাতটায় জব্বলপুর। হোটেলের পাঠানো গাড়ী খুঁজে নিয়ে সোজা ‘হোটেল পরশ’।

মার্বেলরকস্

২৪শের সকাল – আয়েষ করে হোটেলের রুমেই চা-পর্ব সারলাম। আজ জব্বলপুরে ঘোরাঘুরি সেরে নিতে হবে, আগামীকাল কানহা রওনা। দিদি ও লিপি বাজারে গিয়ে খবর নিয়ে এল – সামনেই বাসস্ট্যন্ড, সেখান থেকে অটো ভাড়া নিয়ে ঘুরতে ষাওয়াটাই সাশ্রয়। আমিও কানহার খোঁজখবর একপ্রস্ত সেরে রাখলাম। চারজনে চাররকম খাবার খেয়ে বেলা ১১টায় ‘পরশ’ ছাড়লাম। অটো নিয়ে রওনা – প্রথম গন্তব্য ‘ধুঁয়াধার ফলস্’। মাকে নিয়ে মজা করতে করতে তিন বুড়ো ছেলেমেয়ে অটোর ফটফট্ শব্দ ম্লান করে দিয়েছি। হঠাৎ ড্রাইভার ছেলেটি আমাদের নেমে যেতে নির্দেশ করে – এত তাড়াতাড়ি চলে এলাম নাকি! ভুল ভাঙল – অটো বদল হবে! এখানে এমনই রেওয়াজ, এবার দু’জন সহযাত্রীও জুটল। প্রায় ১ঘন্টা পর ২১ কিমি রাস্তা পার করে ধুঁয়াধার! না এখনই দর্শন নয়! – সামনের ছোটো ছোটো হস্তশিল্পের পসরা সাজানো দোকানের সারি পেরিয়ে নদীর চরের মধ্যে দিয়ে কংক্রিটের রাস্তা নেমে গিয়ে একেবারে মুখোমুখি নর্মদার প্র্রপাত, ধুঁয়াধারের – পুরোটই পায়ে হাঁটা। তবে গাড়ী নিয়ে কাছাকাছি চলে যাওয়া যায়, নিষেধ শুধু অটোর! গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে হনহন্ করে হেঁটে জলপ্রপাতের মুখোমুখি – ছবি তুলছি, কিন্তু বে-আক্কেলের মত ভুলে গেছি বাকি সবার কথা! হুঁশ ফিরতে তাকিয়ে দেখি মা ধীরে ধীরে দিদির হাত ধরে আসছে, রোদ্দুরে মায়ের রক্তবরণ মুখ দেখে আবার এতটা পায়ে হাঁটা পথে ফিরে যাবার চিন্তা মনে উদ্বেগ জাগায়! তবে সবার খুশিখুশি মুখে উদ্বেগ কাটতেও সময় লাগেনা! ধুঁয়াধারের সাথে আধঘন্টার সখ্যতা কাটিয়ে ফিরি, -ঘড়িতে বেলা ১টা। তেষ্টায় সবারই গলা শুকিয়ে কাঠ। গাড়ীভাড়া না করে শেয়ার অটোর ব্যাবস্থায় মা সরাসরি অনাস্থা প্রকাশ করায় অটো রিজার্ভ করি। পরের দ্রষ্টব্য চৌষট্টি যোগিনী মন্দির ঘুরে ভেদঘাট – অন্তত ৩০০ফুট নীচে নেমে মার্বেলরকস্ এর ঘাট। ঘাটে নেমে নরম পানীয়ে তৃষ্ণা নিবারণ। সবাই একটু চাঙ্গা হই। এবার অনিচ্ছুক মাকে নৌকাবিহারে রাজি করানোর পালা, – ঠিক হয় নৌকা, ঘন্টায় ৪০০টাকা। পান্নাসবুজ নর্মদার বুকে নৌকায় ভাসমান ৭টি প্রাণ। স্রোতের বিপরীতে এগিয়ে চলেছি পাথরের বুক চিরে, – নানা বর্ণের পাথরের প্রতিবিম্ব নর্মদার গভীর জলকে আরও মায়াবী করে তুলেছে, নদীর বাঁকে বাঁকে পাথরের আড়ালে বিচিত্র ক্যানভাস নিয়ে দাড়িঁয়ে নর্মদা – কানে একটানা দাঁড়ের ছলাৎ ছলাৎ আওয়াজ। এ যেন প্রকৃতির নিজস্ব দরবারে নির্জন আর্টগ্যলারী দর্শন! মাঝিরা দাঁড় টানে, নৌকা এগিয়ে চলে নর্মদার গভীর থেকে গভীরতর জলে –প্রাণ ভরে ছবি তুলি। জায়গায় জায়গায় পাথরের বিচিত্র রূপ – মাঝি সর্দার তা অননুকরণীয় ভঙ্গীতে ব্যক্ত করে! লিপি বলে, “উঃ এত সুন্দর! জানিনা আমাদের দেশের যাঁরা গ্র্যন্ডক্যানিয়ান দেখতে যান, তাঁদের কতজন এখানে এসেছেন!” ওর সাথে সহমত পোষন করি। সত্যিই আমার দেশকে ‘দেখে দেখে আঁখি না ফেরে’!

একঘন্টার মার্বেলরকস্ দর্শণের সুখস্মৃতি নিয়ে আবার অটোয় চড়ি, – ঘড়িতে বিকেল ৫টা, এবার দেখব ব্যালেন্সিং রক্ ওখান থেকে মদন মহল দূর্গ। সব সেরে যখন হোটেলে ফিরি, তখন বেলা গড়িয়ে সন্ধ্যে ৭টা। সারাদিনের অফুরাণ এনার্জির সবটুকুর ক্লান্তিতে রুপান্তর ঘটেছে! মুখেচোখে জল দিয়ে আবার আগামীকালের ভাবনা। গাড়ী ঠিক করতে বের হই, – হোটেল মালিক অল্পবয়সি শিখ যুবক-‘অংশ্ ছাবরা’, ওর সাথে কথা হয়। – ঠিকহয় ওর গাড়ী-ই আমাদের কানহা নিয়ে যাবে, চালক ‘সাগর’, ওর সাথে আগেই আলাপ – প্রথম দিন স্টেশন থেকে ওই আমাদের সারথি ছিল, তাই আশ্বস্ত হই। নিশ্চিন্ত মনে রাতের খাবার সেরে বিছানার আশ্রয় – মনে ‘বাঘমামার’ স্বপ্ন নিয়ে চোখে ঘুম নামে।

সকালে ঘুম ভাঙে দেরি করে, উঠি আরও দেরিতে – ঘড়িতে সাড়েসাতটা। পা ভাঙার পর কালই সবচেয়ে বেশী ঘোরাফেরা হওয়ায় পর্যাপ্ত বিশ্রাম। বেরোনোও দেরি করে, তাই ধীরলয়ে দিন শুরু। প্রথম দিন ১৮টাকা কাপ চা-এর ধাক্কা সামলাতে হোটেলের বাইরে থেকে চা আমদানি করতে হচ্ছে! চা খেয়ে স্নান সেরে জলযোগ – তারপর তল্পিতল্পা গুটিয়ে একেবারে হোটেলের ‘রিসেপশন্’। বেলা সাড়েদশটা – বিল্ মেটাই। এবার গাড়ীর অপেক্ষা – ‘সাগর’ আসে দেরি করে, ‘অংশ্’ কে বিদায় জানিয়ে ১১টায় রওনা দিই। আধঘন্টা পেরোতেই শহরের গন্ডি ছাড়াই। দু-একটা লোকালয় ছাড়াতেই বদলেযায় দৃশ্যপট্ – দুধারে উঁচুনিচু জমি আর পেল্লাই শালের জঙ্গল – মসৃন পিচরাস্তা চলেছে তার বুক চিরে। মাঝেমাঝে রাস্তা পাক্ দিয়ে ওঠে টিলার মাথায়, আবার নামা অন্য প্রান্ত ধরে – গাড়ী চলে হু হু গতিতে। মাইলের পর মাইল রাস্তা, – দু-ধার পরিচ্ছন্ন, সবুজ বন মনকেও সজীব করে। নিজেদের সম্পদ নিয়ে এত মমতা, এত সচেতনতা কোথাও দেখিনি! এ তো শুধুই কঠোর অনুশাসনে হতে পারেনা- নিজের দেশ, নিজের সম্পদের প্রতি গভীর মমত্বেই এরা নিজেদের আরও সুন্দর, আরও সমৃদ্ধ করেছে! একই দেশের অধিবাসী হয়ে এরা পারে আমরা পারিনা – লজ্জাবোধ হয়! মনে পড়ে জব্বলপুর বাসস্ট্যন্ডে দেখা বিশাল হোর্ডিংটার লেখাগুলো – “আপনার ভালবাসার আপনজনটির জন্মদিন পালন করুন – একটি গাছ লাগিয়ে”। ছোট্ট বার্তা, কিন্তু কি গভীর তার অর্থ! দীর্ঘ ৩ঘন্টা উঁচুনিচু আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে আরএক জেলাশহর মান্ডলা। একসময় রানি দূর্গাবতীর রাজধানী। খিদেয় পেট চুঁইচুঁই – সাগরকে একটা ধাবায় দাঁড়াতে বলি। শহরে ঢোকার মুখেই হোটেল বালাজি – পরিচ্ছন্ন ধাবা। তৃপ্তি সহকারে আহার পর্ব সেরে আবার গাড়ীর সওয়ার হই। মান্ডলা পেরোতেই রাস্তার দু-পাশের প্রকৃতির পরিবর্তন চোখে পড়ে! – এদিকের রাস্তা সমতল, কিন্তু দু-দিকের টিলা গুলোর উচ্চতা বেশী – সেগুলো আবার অসংখ্য পেল্লাই মাপের পাথরে ঢাকা। -অনেকটা আমাদের ‘মামা-ভাগ্নে’ পাহাড়ের মতো! আধঘন্টা চলার পর কানহার রাস্তা বাঁদিকে বাঁক নিল, – কিছুদুর এগিয়েই চেকপোস্ট, – সাগর জানলার কাঁচ নামিয়ে বলল – “বাব্বু ভাইয়াকি গাড়ী”।
কৌন বাব্বু ভাইয়া ?

বিধায়কজি!

বাঘের পা

চেকপোস্টের ছেলেটি সাথে সাথে হাত নেড়ে যেতে ঈশারা করে! সওয়ারি চারজনেরও তখনই মালুম হয়-তারা কোনো ‘বিধায়ক’ বাবুর গাড়ীর সওয়ার! আমি আলেকজান্ডার নই, আর সঙ্গী ‘সেলুকাশ’-ও না থাকায় নিজের মনেই দেশের বিচিত্রতার বাণী আওড়াই! এদিকের রাস্তা সরু। দু-দিকে হালকা শাল-সেগুনের জঙ্গল আর মধ্যে মধ্যে কিছু রিসর্ট ও হোটেল। অনেকে নিজেদের বসবাসের বাড়ীটিতেও হোটেলের সাইনবোর্ড ঝুলিয়েছেন! আরও আধঘন্টা পর পৌঁছে যাই কানহা’র প্রবেশদ্বার – ঘড়িতে বেলা ৩টে। ফরেস্ট অফিসে খোঁজ নিয়ে জানতে পারি, – কানহায় সাফারি বুকিং হয় ‘অন্ লাইন’ অর্থাৎ ইন্টারনেট মারফত্। নির্দিষ্ট দিনের ৩মাস আগে এই বুকিং শুরু হয়। আগামীকাল সকালে আমরা সাফারির অনুমতিপত্র পেতে পারি কিনা জিজ্ঞেস করায় উপস্থিত অফিসার কোনও আশার বাণী শোনাতে পারেন না! এখন পুরোটাই অনিশ্চিত অবস্থায় বুঝে ওখানের স্থানীয় কিছু যুবকের সাথে যোগাযোগ করি, – আলাপ হয় সন্তোষ যাদবের সাথে। – ওর কাছেই জানতে পারি, ও এখানে একটি রিসর্টের ম্যানেজার, নাম ‘বন বিহার রিসর্ট’। ও জানায়, আমরা যদি ওর রিসর্টে উঠি তাহলে আমাদের সাফারি’র অনুমতি পত্রের জন্য ও সবরকম চেষ্টা করবে। আসলে সব অনলাইন বুকিং-ই শেষ পর্যন্ত থাকে না, -কিছু বুকিং ক্যানসেলও হয়। সেক্ষেত্রে আগে এসে আগে পাবার ভিত্তিতে কিছু অনুমতিপত্র পাওয়া যায়। দিনে ২বার সাফারি হয়, -প্রথম, সকাল ৭টা থেকে ১২টা আর দ্বিতীয় বেলা ৩টে থেকে ৬টা। সকালের জন্য ৮০টি আর বিকেলে ৫৩টি অনুমতিপত্র দেওয়া হয়। বনবিভাগের অফিসের কাউন্টার খোলা হয় সকাল ৬টায়। সন্তোষ জানায়,- ও ভোর ৪টে তে উঠে আমাদের জন্য লাইনে দাঁড়াবে, প্রথম ৫জনের মধ্যে থাকতে পারলেই অনুমতি মিলবে বলে ওর বিশ্বাস, তবে কাল ২৬শে জানুয়ারি, তাই ভীড়ও বেশী হবে! অগত্যা ওর রিসর্টে রাত্রিবাস করব বলেই স্থির করি। জঙ্গলের লাগোয়া প্রায় ২০কাঠা জায়গা জুড়ে বন বিহার রিসর্ট। পরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ঘরের ভেতর সুন্দর করে সাজানো, স্যাটেলাইট সংযোগ সহ রঙীন টিভি, বাথরুমে গরম-ঠান্ডা জলের ব্যাবস্থা – সবকিছু মিলিয়ে বন বিহারের আগে এই ‘বন বিহার’ স্বস্তি দেয়! এখানে ঠান্ডা ভালোই, তায় জঙ্গল সাফারিতে এসেছি, -উপরন্ত ৩দিন ধরে টানা নিরামিষ ভোজন চলছে, – ঠিক হয় আজ রাত্রের খানা – গরম ভাত আর মুরগীর মাংস! রাত্রি ৯টা বাজতেই দরজায় টোকা পড়ে, – খাবার তৈরী। মা’র খাবার ঘরে নিয়ে আসতে বলি, -মা’র খাওয়া শেষ হতেই তিন ভাইবোন ডাইনিং-এ উপস্থিত। বাইরে বেশ ঠান্ডা, টেবিলে আসতে আসতেই খাবারের অর্ধেক উত্তাপ উধাও! আর খাবার মুখে পড়তেই আমিষের প্রতি মনের সব আসক্তি উধাও, – এত অখাদ্য মাংস রান্না কোথাও খেয়েছি বলে মনে করতে পারিনা! কোনোরকমে তাই গলধঃকরণ করে রাত ১০টার মধ্যেই কম্বল ঢাকা নিয়ে শুয়েপড়া।

হঠাৎ মোবাইল বেজে ওঠে – বিরক্তি নিয়েই কানে নিই – ও প্রান্তে গলা ভেসে আসে – “সাব্ আজ বহুৎ ভীড় হ্যায়, আপ প্লিজ্ চলে আইয়ে ইধার গেট মে”।

বলি – অভি যানা হ্যায়! – উত্তর আসে-
হ্যাঁ সাব্।

অগত্যা, উঠে পড়ি – ঘড়িতে পৌনে চারটে। তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে বাইরে আসি, চারদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার – পাশের জঙ্গলের গাছগুলো অন্ধকারে বড় বড় দৈত্য বলে বোধহয়! রিসর্টের বাইরে রাস্তায় আসতেই দৃষ্টি অনেকটা পরিস্কার হয়, – পশ্চিম আকাশে তখনও পেল্লাই চাঁদের উপস্থিতি, দু-দিন পরেই পূর্ণিমা। রাত্রি শেষের পাহারায় সারমেয়র দল একটানা ভৌ ভৌ শব্দে তাদের কর্তব্য নিষ্ঠার প্রমান রাখছে। এভাবেই মিনিট ছয়-সাতের মধ্যে পৌঁছে যাই ‘গেট’-এ। সন্তোষের সাথে দেখা হয়, হিন্দিতে যা বলে তার সারমর্ম হল – আজ ২৬শে জানুয়ারি, ভীড় একটু বেশি, তাই যাঁরা সাফারি করবেন তাঁরা নিজেরা লাইনে দাঁড়ানোই ভালো’ নয়তো ফরেস্টের লোকেরা গোলমাল পাকাতে পারেন! তবে চিন্তার কোনো কারন নেই, ও আগে এসে ৩নম্বরে লাইন রেখেছে, আমরা নিশ্চিত ভাবেই পারমিট্ পেয়ে যাব।

লাইনে গিয়ে দাঁড়াই, আমার সামনে একজন মহিলা, -রাত্রি ৩টে থেকে লাইনে দাঁড়িয়ে আর একেবারে সামনে দাঁড়ানো ছেলেটি রাত্রি ১২টা থেকে কম্বলমুড়ি দিয়ে অপেক্ষারত! এই হাড় কাঁপানো ঠান্ডায় ওঁদের উৎসাহ এবং নিষ্ঠাকে মনে মনে কুর্নিশ করি। সময় যায় ভীড়ও বাড়তে থাকে, – এভাবেই একসময় ঘড়ির কাঁটা জানান দেয় ৬টা বেজেছে, – কাউন্টারও খুলে যায় – শুরু হয় অনুমতি পত্র দেবার পালা – ঘড়ির কাঁটা এগিয়ে চলে, এখন সোওয়া ছ’টা অথচ লাইনের সবাই যে যেখানে ছিলাম সেখানেই আছি, তাহলে হচ্ছেটা কি! খবর নিয়ে জানা গেল – অনলাইন বুকিং এর অনুমতিপত্র বিলি চলছে, কোনো ক্যানসেলেশন থাকলে তবেই তার জায়গায় লাইনে দাঁড়ানো লোকেরা অনুমতিপত্র পাবেন! সকলেরই উদ্বেগ বাড়তে থাকে, – ৬টা ২০মিঃ নাগাদ আমার সামনে দাঁড়ানো অপেক্ষারতদের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে। এবার আমার পালা, লাইনে দাঁড়িয়ে প্রায় অধৈর্য হয়ে উঠেছি এমন সময় আমার দরখাস্তের ডাক পড়ে, – অনুমতি পত্র হাতে নিয়ে যখন লাইন থেকে বেরিয়ে আসি ঘড়িতে ৭টা বাজতে ১০মিঃ বাকি। সন্তোষের সাথে দ্রুত রিসর্টের পথে ফিরি। রিসর্টে সাফারির জিপ আছে, আমরা ওতেই যাব। আমাদের সঙ্গী আরও একটি ফ্যামিলি, স্বামী-স্ত্রী ও ওঁদের জমজ কন্যাদ্বয় – ওঁরাও কাল সন্ধ্যেবেলা বন বিহার-এ এসে উঠেছেন। যেহেতু একটি অনুমতিপত্রে সর্বাধিক ৫জনের অনুমতি পাওয়া যায়, তাই আমাদের দরখাস্তের সাথে ওঁদেরও জুড়ে দিয়েছিল সন্তোষ(অনুর্ধ পাঁচ বছরের বাচ্চাদের অনুমতিপত্র লাগেনা)। রিসর্টে ফিরেই গরম চা-এ চুমুক দিই, -ঠান্ডায় হাড় জুড়োনো! আলাপ হয় আমাদের সহযাত্রিদের সাথে, – সুপ্রভাত জানিয়ে সবাই জিপ-এ সওয়ার হই। গাইড্ সাহেব –রূপ সিং চড়তেই জিপ চলতে শুরু করে।

গেটে পারমিশনের কাগজ দেখিয়ে যখন ভেতরে প্রবেশ করি তখন সকাল সোওয়া ৭টা। প্রায় ১৯৪৫ বর্গ কিমি এলাকা নিয়ে কানহা ন্যাশনাল পার্ক। এত বড় আয়তনের দরুন সাফারির জন্য একে – কিসলি, মুক্কি, কানহা ও সারহি এই ৪ভাগে বিভক্ত করেছেন কতৃপক্ষ । আমরা পেয়েছি সারহি জোন-এ ঘোরার অনুমতিপত্র। খবর নিয়ে জানলাম ২০১০এর গনণা অনুসারে এই জঙ্গলে ১১২টি বাঘ আছে, যারমধ্যে ৮১টি পূর্ণ বয়স্ক বাকি ৩১টি শিশু। এখানে সকাল দেরী করে হয় – সবে সূর্য উঠেছে, নরম রোদ জঙ্গলের সবুজ জাল ফালাফালা করে চারদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ছে। কনকনে ঠান্ডায় সবাই ঐ টুকরো রশ্মির প্রত্যাশি, – সকলেরই জুবুথুবু অবস্থা! সাধ্যমত শীতবস্ত্র গায়ে দিয়েও ঠকঠকানি যায় না। খোলা জিপ এগিয়ে চলে গভীর থেকে গভীরতর জঙ্গলের দিকে। মধ্যে মধ্যে চিতল হরিণের দেখা মিলল, – তাতেই সবাই বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছি। আমাদের সঙ্গী ভদ্রলোক গাইডের সাথে গল্প জমিয়েছেন, কানে আসে, -“বাচ্চে লোগোকে লিয়ে আয়া হ্যায়, ম্যায় তো ‘জু’ মে, ‘সার্কাস্’ মে শের দেখে হ্যাঁয়, ইয়ে লোগ তো দেখ্ নেহি পায়েগি,- অভি তো ‘সার্কাস্’ মে ভি শের কা খেল ‘ব্যান’ হো গ্যায়া”। তাজ্জব হয়ে শুনি, আর ভাবি -প্রকৃতির অন্দরমহলে এসেও কারও চিড়িয়াখানা কিংবা সর্কাসের কথা মনে হয়! প্রকৃতির সাথে দুরত্ব বাড়িয়ে ফেলা মানুষ হয়তোবা আজ তার চারপাশে নিজের প্রতিবিম্বই খুঁজে বেড়ায়।

কানহা

মিনিট ১৫ যেতেই গোঁ গোঁ শব্দ করে জিপ চড়াই ভাঙতে শুরু করল, -আরও গভীর জঙ্গলে আমরা! রাস্তার দু’-পাশে ছোট ছোট বাঁশের ঝাড় আর তার পরেই পেল্লাই বনস্পতিদের অবরোধ! অসম্ভব ঠান্ডা, খোলাহাতে ক্যামেরা ধরে রাখাই দায়! – জানিনা ছবি আদৌ তুলতে পারব কিনা! মাঝে মাঝে কিছুটা খোলা জায়গা, – সেখানে জঙ্গলের নানা দিক থেকে আসা কতগুলো রাস্তা একসাথে মিশেছে। অন্য রাস্তা ধরে আসা পর্যটকদের গাড়ির সাথে দেখা হচ্ছে, ড্রাইভাররা নিজেদের মধ্যে কথা বলে নিচ্ছেন সেখানে। আবার অন্য দিকে ফেরা। এভাবেই হঠাৎ এক উৎরাই এর পথে দেখা মিলল বুনো শুয়োরের, আরও কিছুক্ষন পর পৌঁছলাম বিস্তির্ণ এক খোলা জায়গায়, প্রকান্ড এক সমতল প্র্রান্ত, তাতে বড় বড় ঘাস – দেখা মিলল কানহা’র বিখ্যাত বারাসিঙা’র! দলে দলে বারাসিঙা, চিতল সকালের রোদ্দুর পিঠে নিয়ে খাওয়ায় ব্যস্ত – কানে আসে জঙ্গলের ‘ভৈরবি’ – রকমারি পাখির ডাক, বাঁদরের কিচিরমিচির, একটানা ঝিঁঝিঁর ডাক সব মিলিয়ে প্রকৃতি যেন উদাত্ত কন্ঠে প্রভাতি রেওয়াজে ব্যস্ত! মিনিট পাঁচ দাঁড়িয়ে আবার চলা শুরু, গভীর অরন্যে মাঝে মাঝেই কিছুটা জায়গা(১৫-১৬ফুট বর্গ ক্ষেত্র) পরিস্কার করে চেঁছে রাখা, – গাইড সাহেব জানালেন এখানে চলাফেরারত জানোয়ারদের পা-এর ছাপ দেখে বনবিভাগের কর্মীরা ওদের শারীরিক অবস্থা সম্মন্ধে অনুমান করেন। হঠাৎ এমনই একটি জায়গায় এসে আমাদের ড্রাইভার ব্রেক কষেন, রূপ সিং-ও উত্তেজিত – সদ্য যাওয়া বাঘের পা-এর ছাপ! গাইড সাহেব মুখে আঙুল দিয়ে সবাইকে চুপ করার নির্দেশ দেন- দূরে নাকি শোনা যচ্ছে বাঘের আওয়াজ, একটানা খ্যাচ্ খ্যাচ্ শব্দ – এ নাকি সঙ্গীকে আহ্বান জানানোর আওয়াজ! বাঘের ডাক বলতে ‘হালুম’-ই জানি, তাই মনে অবিশ্বাস নিয়েই কৌতুহলি হই! মিনিট১০ পর আবার গাড়ি চলে, -এমনি করেই ৯টা৩০ নাগাদ কিসলি গেট্-এ এসে টিফিনের যাত্রাবিরতি। অন্তত ২৫-২৬টা জিপ দাঁড়িয়ে, যাত্রীরা সকলেই খাওয়ার থেকে রোদ পোহানোতে উৎসাহি, তারই মাঝে গরম চা’র জন্য লম্বা লাইন! ড্রইভারেরা নিজেদের মধ্যে আলোচনা সারে, সকলেরই এক হা-হুতাশ ‘শের নাহি মিলা’! তাহলে কি জঙ্গলেই রাজা বিনা রাজ্য আটক যায়! রোদ্দুরে হাত-পা’র সাড় ফিরতেই শুরু হয় চলার ব্যস্ততা –আবার ফিরি গভীর অরন্যে। দেখা মেলে ময়ূর-ময়ূরীর, এগিয়ে চলি, – চকিতে ড্রাইভার ব্রেক চেপেন, সবাই আচমকা ঝাঁকুনি খেয়ে বেশ বিরক্ত – ব্যাকগিয়ারে জিপ কিছুটা পিছিয়ে গিয়ে দাঁড়িয়ে যায় – গাইড রূপ সিং ঈশারায় বাঁ দিকে দেখতে বলেন – বিশাল আকৃতির এক বাইসন! –যেন পা-এ সাদা মোজা আর মাথায় সাদা রুমাল ফেট্টি পরিহিত এক বুনো মোষ। আমাদের ভ্রুক্ষেপ না করে একমনে খাওয়ায় ব্যস্ত – আমাদের প্রতি চরম তাচ্ছিল্ল নিয়ে ধীরে ধীরে রাস্তা পার হয় – আমরা সবিস্ময়ে দেখি আর ছবি নিই। -ড্রাইভার জানায় ওরা জঙ্গলে সবচেয়ে ভয় করে এই চতুস্পেয়টিকে, এরা অবলিলায় যাত্রীবাহি জিপকে উল্টে ফেলতে পারে, আমরা যে বাইসনটিকে দেখলাম তার ওজন অন্তত ১টন।

বাইসন

জঙ্গলের কাঁচা রাস্তায় পাক্ খেতে খেতে সকলেই কম-বেশী ক্লান্ত, বাঘ দেখার আশা সকলে প্রায় ছেড়েই দিয়েছি, ঘড়ির কাঁটাও সাড়ে১১টা ছাড়িয়েছে, এমন সময় গাইড আবার গাড়ী থামিয়ে হরিণ দর্শন করান – শুনতে পাই মা’র বিরক্তি মেশানো গলা –“চুপ কর মুখপোড়া, এখানে বাঘ-টাঘ কিছুই নেই, শুধু হরিণ দেখাচ্ছে, – এ তো ‘ডিয়ারপার্ক’, এরজন্য এত কষ্ট! আমাদের সিটিসেন্টারেও তো ডিয়ারপার্ক আছে, এসব তো ওখানেই দেখতে পেতাম!” –শুনে মনে মনেই হো হো করে হাসি।

ঠিক পৌনে১২টায় আবার মূল গেটে পৌঁছলাম। জীবনের প্রথম জঙ্গল সাফারি শেষ! খুব উপভোগ্য বলব না, – মৌনি প্রকৃতিতে সদলবলে এমন সশব্দ ভ্রমন কোথায় যেন মনের ভেতর কুন্ঠার উদ্রেক করে! জঙ্গলের অধিবাসীদেরও খুব স্বস্তি দেয় কি।


0 Comments

Leave a Reply

Avatar placeholder

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!