সূর্যাস্তের রঙকেও ফিকে করে দেয় বসন্তের ‘বড়ন্তির’ রঙ

Published by Editor on

পলাশ

সূর্যাস্তের রঙকেও ফিকে করে দেয় বসন্তের ‘বড়ন্তির’ রঙ

-তড়িৎ কুমার সরকার

“কোনোদিন গেছো কি হারিয়ে,
         হাট-বাট নগর ছাড়িয়ে
দিশেহারা মাঠে……
       একটি শিমুল গাছ নিয়ে,
আকাশের বেলা যেথা কাটে”

অনেক দিন ধরে যাবার ইচ্ছে রাঢবঙ্গে আরও বিশদে বলতে গেলে বলতে হয় সাঁওতাল পরগনার বড়ন্তিতে। শুনেছি বসন্তের বড়ন্তির রঙ নাকি সূর্যোদয়ের বা সূর্যাস্তের রঙকেও ফিকে করে দেয়। তার সঙ্গে লাল মাটির রাস্তা, গ্রামের টালির বাড়ির মাথার ঐ রঙ সব কিছু চাক্ষুষ না করা পর্যন্ত আমার  শান্তি নেই। উপর উপরি পাওনা হিসাবে মুরাডি লেকের জলে সূর্যাস্তের ছবির সঙ্গে বড়ন্তি পাহাড়ের ত্রিকোনাকৃতি প্রতিচ্ছবি এত কিছুর আকর্ষণ উপেক্ষা করি কেমন করে। তার উপর আমার চোখে আপনাদেরও বড়ন্তিদেখাতে হবে না? এমত অবস্থায় সুযোগ পেয়ে গেলাম। SBI SRC GMUK এর বার্ষিক পিকনিকের জন্য এই বড়ন্তিই ঠিক করা হল। সকালে বাস ছাড়ল। আমরা বর্ধমানআসানসোলের রাস্তা ধরলাম। পথ যেন আর শেষ হয় না। একে একে ধানিয়াখালী, গুড়াপ, বর্ধমান, মানকর, গোপালপুর, দুর্গাপুর, রানীগজ্ঞ হয়ে প্রায় ২১৩ কিমি পথ অতিক্রমকরে অবশেষে আসানসোল। শহরের মধ্যে দিয়ে এসে পৌঁছালাম নিয়ামতপুর। ডানদিক থেকে বাইপাস এসে এখানে মিলিত হল। আমরা বাঁদিকের রাস্তা ধরলাম। এবার আবার এগিয়ে চলা। দিশেরগড় ব্রীজ পার হয়ে দূর দূরান্তে কোথাও না কোন টিলার দর্শন পাচ্ছি না কোন পলাশ ফুলের। চিন্তিত যেমন আমরা ঠিক তেমনই ড্রাইভার সাহেব। ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি তো? আমাদের চিন্তা হরণ পাস দিয়ে চলা গাড়ির ড্রাইভাররা। ওদের কাউকে জিজ্ঞাসা করার আগে বিপিন ঘোষণা করলো ঠিক রাস্তায় চলেছি আমরা। চিন্তা নেই এখান থেকে ২৫ কিমি দূরে শর্বরী মোড় হয়ে তারপরে বাঁহাতে যেতে হবে। ১২ কিমি দূরে বড়ন্তি।

লেকের জলে এসে পড়েছে বড়ন্তি পাহাড়ের প্রতিচ্ছবি

জলজ্যান্ত চিন্তাহরণ পেয়ে ওকে….. না ওকে বলা ভুল, ওর মোবাইল সহিত ওকে কেবিনে নিয়ে আসা হল। ওই পথ দেখাবে। শর্বরী মোড় থেকে বাঁদিকে ঘুরে কিছুটা যাবার পর দূরে টিল এবং জঙ্গলে লালের আভা দেখা দিল। একটা রেল লাইন পারহয়ে চিন্তা মুক্ত না হয়ে দ্বিগুণ চিন্তায় পড়লাম। একোন রাস্তায় এসে পড়লাম। ভারী মালবাহী ডাম্পার চলার ফলে দুই দিকে রাস্তা নীচু হয় গেছে আর মধ্যিখানে উঁচু। বাস  ডাম্পারের রাস্তা ধরতে পারছে না। একদিকের চাকা উঁচু অংশে তুললে বাস উল্টে যেতে পারে। শেষে ঠিক হল বাস খালি করে সকলে হেঁটে ৫০০ মিতারের মতন রাস্তা পারহয়ে যাবার পর খালি বাস অতি সাবধানে নিয়ে আসলো ড্রাইভার সাহেব। বাকি রাস্তা বিপিনকে বাঁচিয়ে দিল গালি খাওয়ার হাত থেকে। গ্রামের মধ্যে দিয়ে পাকা রাস্তা। গ্রামশেষে দেখা দিল যার জন্য আসা সেই পলাশ গাছ ফুলে লাল হয়ে আছে। আমরা এসে পৌঁছালাম Baranti wild life and nature study hut এ। সকলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল। স্নান খাওয়া বিশামের পর সকলে ঘর থেকে বের হল পড়ন্ত বিকেলে। গ্রামের এবং কিছু হোম স্টে ও কটেজের পাশ দিয়ে লাল মাটির রাস্তা ধরে প্রায় ৩০০ মিটার হেঁটে পৌঁছালাম ড্যামের ধারে লাল মাটির রাস্তায়।

আহা রাস্তার দুপাশে পলাশের গাছ লাল হয়ে দাঁড়িয়ে আমাদের গার্ড অফ অনার দিচ্ছে। লাল মাটির রাস্তায় পড়ে থাকে পলাশ যেন লাল কার্পেট বিছিয়ে দিয়েছে। লেকের জলে এসে পড়েছে বড়ন্তি পাহাড়ের ত্রিকোনাকৃতি প্রতিচ্ছবি। আর সূর্যদেব এতক্ষণে যেন তার ঝলসান রূপ ছেড়ে আমাদের আপন করে নিয়ে শান্ত সিগ্ধ রূপ ও রঙ দিয়ে শুধু লেকের/ড্যামের জলকে রাঙিয়ে দিচ্ছে না, আমাদের মনেকে রাঙিয়ে দিচ্ছে। সন্ধ্যার অন্ধকার আর মশার তাড়ায় আমরা ফিরে চললাম আমাদের ২দিনের আবাসস্থলে, বহুদিন মনের মনিকোঠায় সঞ্চিত হয়ে থাকবে এই বিকেলের মন ভুলানো রূপ। এর পরের ঘটনা একই। সেই পকোড়া চা সহযোগেসন্ধ্যার জলযোগ। রাতে রুটি মাংস খেয়ে ঘুম। শুধু একটাই উল্লেখ করার বিষয়, যে কেয়ার টেকারের মুখে “এখানে আগে সামনের জঙ্গল থেকে হরিণ চলে আসত” শুনে আমাদের দলের এক সদস্য রাতে স্বপ্ন দেখলেন তার দোতলার জানলা দিইয়ে জিরাফ মাথা গলিয়ে ওনার মাথার চুলে নাকি বিলি কেটে দিয়ে গেছে। ফল স্বরূপ আমাদের ভোর ৪.৩০ টাথেকে উঠে ভোর না হওয়া পর্যন্ত নরক যন্তনা ভোগ করে ভোরের আলো ফোটার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় নামলাম, না চায়ের খোঁজে নয় খেজুরের রসের খোঁজে। খেজুরের রস পানকরে কালকে যে রাস্তা দিয়ে এসে ছিলাম গ্রামের ভিতর দিয়ে সেই রাস্তা ধরলাম। রাস্তার দুপাশে পলাশের গাছ লালে লাল। পাশের জঙ্গল পর্যন্ত লাল হয়ে রয়েছে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বড়ন্তি পাহাড়। আমরা নিজেদের মনে গল্প করতে করতে হেঁটে চলেছি হঠাৎ দেখি সূর্য্যিমামা দেয় হানা গায়ে লাল জামা ঐ।  ধুধু প্রান্তরের শেষে গাছের ফাঁকে উনি যেনআমাদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছেন। আমরা যেমন যেমন এগোছি একবার উনি গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে যাচ্ছেন আবার নিজ রূপে উদ্ভাসিত হচ্ছেন।

বড়ন্তি

আমাদের টিফিন করে বেরহতে হবে বিহারিনাথ পাহাড়ের উদ্দেশ্য। তাই ফিরে চললাম নেচার হাটের দিকে। বিহারিনাথ পাহাড় বাঁকুড়ার সর্ব উচ্চ পাহাড়। পূর্বঘাট পর্বতমালার অংশ বিশিষ্ট এই পাহাড়ের উচ্চতা ৪৫১ মিটার বা ১৪৮০ ফুট। বাঁকুড়া শহরের উত্তর-পশ্চিম দিকে ৬০ কিমি দূরে এবং সালতোরা শহরের ১৪ কিমি দূরে। একে পশ্চিমবঙ্গের আরাকু ভ্যালি বলা হয়। এই পাহাড়ি অঞ্চলের আশে পাশে অনেক বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান আছে। এখানে আছে একটি শিবের মন্দির। আমাদের মতন মনে যুবক ও শারীরিক বৃদ্ধের পক্ষে এই পর্বত সঙ্গকুল রাস্তা দিয়ে পাহাড়ে চড়া বিপদজনক বলে কিছুদুর গিয়ে রণে ভঙ্গ দিয়ে ফিরে এলাম। এখানে পাথরের জিনিস উল্লেখের দাবি রাখে। বেশ কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে ফিরে চললাম নিজেদের আস্থানায় দুপুরের খাবার খেতে। বিকেল থেকে গত দিনের অ্যাকশন রিপ্লে, শুধু আমাদের সঙ্গে আসা পুরোহিত ঠাকুরের এক সাজি পলাশ ফুল কুড়িয়ে নেওয়া ছাড়া। মনে রাখবেন এই পুরোহিত হইতে সাবধান। একমাত্র সরস্বতী পুজার মন্ত্র দিয়ে বিয়ে থেকে দুর্গা, কালী ইত্যাদি সব পুজা, পৈতা, শ্রাদ্ধ থেকে সব কাজ করে (অবশ্যই নাটকে)। শেষ পাতে ছিল দৈই এর বদলে সাঁওতালি নৃত্য।

শেষ করার আগে বড়ন্তি সম্বন্ধে কিছু বলে রাখি। কোলকাতা থেকে প্রায় ২৫০ কিমি দূরে, আসানসোল থেকে ৩৭ কিমি দূরে গোরঙ্গি পাহাড়ের কোলে অবস্থিত একটি ছোট আদিবাসীদের গ্রাম। পুরুলিয়া জেলার রঘুনাথপুর সাব ডিভিশনের অন্তর্গত সানতুরি অধীনে। গড়পঞ্চকোট পাহাড় একদিক দিয়ে আর বিহারিনাথ পাহাড় অন্য দিক দিয়ে একে ঘিরে রেখেছে। এটি একটি জলাধার। রঘুনাথপুরে এর জলে নির্ভর করে গড়ে উঠেছে একটি water treatment plant এবং জল সেচ ব্যবস্থা। এখান থেকে বিহারিনাথ পাহাড় ও জয়চন্ডী পাহাড় ২৫ কিমি দূরে, গড়পঞ্চকোট ১৮ কিমি, সুসুনিয়া ৪০ কিমি, মাইথন ৩৮ কিমি, পাঞ্চেত ২২ কিমি, মুকুটমনিপুর ১০৫ কিমি। পরদিন ভোরবেলায় বের হলাম। এবার আর আগের রাস্তা নয়। বড়ন্তি থেকে ড্যামের পাশ দিয়ে মুরাডি গ্রাম ছাড়িয়ে রঘুনাথপুর গ্রাম হয়ে আস্তে হবে কোটালদিহ গ্রাম সেখান থেকে সুভাষ মোড়ে এসে মূল রাস্তায় পড়ে ডান দিকে সোজা গেলে শর্বরী মোড় অতিক্রম করে এগিয়ে চলা। বাকিটা আসার রাস্তার মতন। সুতরাং ভুলেও শর্বরী মোড় থেকে বাঁ হাতে যাবেন না।


0 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!