ত্রিযুগিনারায়ণ – পুরাণে আছে শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল এখানে
Published by Editor on
ত্রিযুগিনারায়ণ - পুরাণে আছে শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল এখানে
– সুমন্ত মিশ্র
ত্রিযুগিনারায়ণ এ এবার ঘুরতে ঘুরতে চলে গিয়েছিলাম ৷পাহাড় থেকে ঘুরে আসার পর চেনা-জানা প্রায় সকলেই একটা প্রশ্ন করে থাকে বা থাকেন, – কেমন ঘুরলি? সে’বার, এক দাদা সদর্থক উত্তর শুনে বেশ বিস্ময় নিয়ে বলল, -তাহলে মানুষকে এখনও বিশ্বাস করা যায় বলছিস! সত্যি বলছি, – যায়, এখনও যায় আর পাহাড়ে তো যায়ই৷ ৫২বসন্ত-বর্ষার জীবনে অনেক অবিশ্বাসের মুখোমুখি হয়েও বলছি, মানুষ হয়ে মানুষে অবিশ্বাসী হতে ইচ্ছে করেনা৷
মানুষ দেখতে, – মানে, নানাধরনের মানুষ দেখতে আমার বরাবরই খুব ভালো লাগে, – সেই হস্টেলে থাকার সময় থেকেই৷ একা একা ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে অগুন্তি মানুষের মাঝে হারিয়ে যাওয়া, আর সেই হারানো ‘আমি’র চোখে সকলের চলন-বলন, অভিব্যাক্তি খুঁটিয়ে দেখার মধ্যে একটা অদ্ভুত ভালোলাগা ছিল তখন, – এখনও সেটা আছে৷ ঐ লোভেই ছুটে যেতাম হরেকরকম মেলাতেও৷ বিশ্বাস করুন সত্যিই হারিয়ে ফেলতাম নিজেকে৷ পৌষের এক শীতে শান্তিনিকেতনের মেলায় আমার এক বন্ধু একবার আমার সাথে গিয়ে বলেছিল, -এসব পাগলের সাথে কেউ আসে৷ আবার, আর এক শীতে বিশ্বভারতী ক্যান্টিনে টেবিলে শুয়ে রাত কাটানোয় ফাল্গুনীদা(তৎকালীন ক্যান্টিন মালিক)আমার বোনকে জিজ্ঞেস করেছিল, -তোর দাদা মাল-টাল খায়? ‘না’ শুনে বলেছিল, -হুঁ, ঐ জন্যই, ওকে একটু করে মাল খেতে বল, -তা’লে মাথাটা ঠিক হয়ে যাবে৷ ফাল্গুনীদার প্রেসক্রিপশন কার্যকর হয়নি আজও, -তাই পাগলামোটাও রয়ে গেছে অল্পবিস্তর! ভাগ্যিস্, তাই নিজের দেশের মানুষদের কাছ থেকে দেখার অভ্যেসটা রয়ে গেছে আজও৷
সেই ‘৯০ থেকে দল বেঁধে পাহাড় যেতে যেতে কখন যেন একা হয়ে গেলাম৷ সেটা বোধহয় ভালোই হল আমার জন্য! পাহাড় দেখার চোখটা গেল পাল্টে, মহামৌন সাদা ঝুঁটির শীতল কোলে জেগে থাকা সবুজ, ওরই ভাঁজে-খাঁজে জীবন খোঁজা মানুষজন, দিগন্ত জোড়া ক্যানভাসের অসীম নীল, অতল খাদে বয়ে চলা প্রাণোচ্ছল ঢেউ –সবই যেন অন্যরূপে চিনতে শিখলাম! নিস্প্রাণ শীতলতায় স্পর্শ পেলাম উষ্ণতার, – নতুন করে গলা জড়ালাম৷ সে’ গলাতেও লেগে আছে মানুষের ঘ্রাণ৷
ত্রিযুগিনারায়ণ এর রাস্তায় (শোণপ্রয়াগ পর্যন্ত) আগেও এসেছি বারদুয়েক কিন্তু শোণপ্রয়াগ থেকে সোজা চলে গেছি গৌরীকুন্ডের পথে, -যতই হোক ওটাই যে এ’ দিকের বড়বাবুর পথ, -কেদারের পথ৷ অথচ বাঁদিকে ঘুরে আর ১৪কিমি এগোলেই গাড়োয়াল হিমালয়ের অপরূপ সুন্দর জায়গা এই ত্রিযুগি, -প্রথম দেখাতেই বলতে ইচ্ছে হয়, -“আমার নয়ন-ভুলানো এলে…”৷ মনে মনে তারিফ করতে হয় ‘হর-পার্বতীর’, -এত জায়গা থাকতে ছাঁদনাতলা বেঁধেছিলেন কিনা এখানেই! পুরাণে আছে শিব-পার্বতীর বিয়ে হয়েছিল নাকি এখানে, সে বিয়েতে কন্যা সম্প্রদান করেন ভগবান বিষ্ণু আর পুরুত ঠাকুর ছিলেন স্বয়ং ব্রহ্মা! বোঝো কান্ড, যে ভুখন্ডে পা পড়েছে এমন তিন মহারথীর সেখানে কিনা পৌঁছে গেছি আমি! এই অহংবোধে তো পা মাটিতে না পড়ারই কথা!-কিন্তু বুঝলাম পা মাটিতেই আছে, -নইলে রবি ঠাকুর মনে আসে! অবশ্য আমার মত অজস্র ভেতো-বাঙালির ব্রহ্মা-বিষ্ণু-মহেশ্বর ঐ একজনই, -রবি ঠাকুর৷ – এও এক ধরনের একেশ্বরবাদ!
ত্রিযুগিনারায়ণ তীর্থস্থান, -আর তীর্থস্থান মানেই ‘পাপের আখড়া’, -অন্তত আমার দেশের ‘শিক্ষিত’ সম্প্রদায়ের একটা বড় অংশ এমনটাই মনে করেন৷ আচ্ছা, সংসারের সর্বত্র যাঁরা পাপকাজে জারিত শুধুমাত্র তীর্থস্থানে এসে তাঁরা পূণ্যাত্মা হয়ে যাবেন, -এমন ভাবনা যাঁরা ভাবেন গলদটা তাঁদের নয় কি? কলকাতা লিগের প্লেয়ার দিয়ে যদি ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগ করানো হয় তাতে তার গুণমান একই থাকে? আসলে সমস্যাটা নির্দিষ্ট কোনো এক জায়গার নয়, সমস্যাটা সামগ্রিক৷- হয়তো আমরা সবাই প্রতিনিয়ত সত্যের পথ থেকে বিচ্যুত হয়ে চলেছি, আর আঙ্গুল তুলছি অন্যের দিকে!
দেখুন, ভণিতা কাকে বলে, -একটা ছোট্টো ঘটনা লিখব বলে বসলাম, -আর লিখে ফেললাম কত কিছু। ত্রিযুগিনারায়ণ এ খাবার দোকানে বসে আছি, -বাইরে বৃষ্টি পড়ছে, -এক কাপ চা চেয়ে তাকিয়ে আছি সামনে মন্দিরের পথে৷ – সে যেন চলমান ভারতবর্ষ, – কেউ গুজরাট থেকে আসছেন তো কেউ কেরালা, কেউ রাজস্থান তো কেউ ছত্তিশগড়৷ –হরেক তাঁদের পোশাক, ভাষা, আদব-কায়দা, – দল বেঁধে তাঁরা আসছেন, পূজো সেরে হৈ হৈ করে আবার ফিরে যাচ্ছেন নিজ গন্তব্যে৷ বেশ লাগছিল! এমনই একদল মহিলা ফেরার পথে যেতে যেতে দাঁড়িয়ে পড়লেন আমার সামনে, -হাতে চায়ের গেলাস দেখে একজন জিজ্ঞেস করলেন, -কেমন, ভালো? আমি সম্মতির ঘাড় হেলাতেই এগিয়ে গেলেন উনুনের সামনে, – সেখানে তখন দুই ক্ষুদে বাবার দোকান সামলাচ্ছে৷ “অ্যাই ভালো করে দুধ দিয়ে চা বানাতে পারবে?” – বলতেই ছোটোভাই(অংশু) বলে ওঠে,-“হ্যাঁ হ্যাঁ, এ আমাদের বাড়ীর দুধ৷” ব্যাস্ অর্ডার হয়ে যায় ৭ গেলাস চা-এর৷ বড়ভাই(ঋষভ) হাত লাগায়, -মহিলারা উনুনের আঁচ পেতে ওদের ঘিরে বসেন৷ কানে আসে ঋষভ ও ঐ ভদ্রমহিলার কথোপকথন, – “পড়াশোনা কর না?” – হ্যাঁ৷ – “কোন ক্লাসে পড়?” ঋষভ উত্তর দেয়, – আমি ক্লাস টুয়েলভ্ আর ও টেন৷ – “স্কুল কোথায়?” – এইতো গ্রামেই৷ –“টিচাররা ভালো পড়ান?” – উত্তর আসে, -হ্যাঁ৷ “পরীক্ষা কবে?” – এই ১৯ তারিখ৷ সেদিন ছিল ১০ তারিখ৷ মহিলা প্রায় আঁতকে উঠে বলেন, “সে কী, তাহলে পড়ছনা?” ঋষভ আশ্বস্ত করে, -পড়া ঠিকই করছে, একটু আগেই ও বাড়ী থেকে পড়া সেরে এসেছে৷ আবার প্রশ্ন, “বড় হয়ে কী হবে বেটা?” ও বলে ‘ফৌজি’ হতে চায়৷ “পরীক্ষা দিয়েছ?” -ঋষভ বলে, ওর এখনও ১৮বছর হয়নি, তাই সামনের বছর পরীক্ষা দেবে৷ এর ফাঁকেই হাতে হাতে পৌঁছে যায় চা-এর গেলাস, -সকলের মুখের অভিব্যাক্তিই বুঝিয়ে দিচ্ছে ওঁদের ভালো লেগেছে৷ পাওনা মিটিয়ে ওঁরা ফিরে যাচ্ছেন, – হঠাৎ দেখলাম ঐ ভদ্রমহিলা ফিরে এলেন, – ঋষভের গালে মাথায় সস্নেহে হাত বুলিয়ে বললেন, “ভালো করে পড়াশোনা কোরো বাবু, অনেক বড় হও, আমার আশীর্বাদ রইল!” – দেখছিলাম আর ভাবছিলাম ধর্মস্থানে এসে যাঁদের শুধুই ধর্মের ‘আফিম’ নজরে পড়ে, এই সব পোস্তদানাগুলো কী করে তাঁদের নজর এড়িয়ে যায়! থেকে প্রায় ২০০০কিমি দূরের কোনো শহর(জনেছিলাম ওরা ব্যাঙ্গালোর থেকে এসেছিলেন) থেকে এসেও কোনো মা এর মন পথের পাশে সন্তান খুঁজে নিচ্ছে, তাকে স্নেহের বন্ধনে জড়িয়ে ধরছে –একে অপরকে জড়িয়ে থাকার এই বাঁধুনিটা তাঁদের নজরে পড়ে না, শুধু ভেঙ্গে ফেলার টুকরো ছবিগুলোই উজ্জ্বল হয়! কী জানি বাপু, আমার আবার এঁদের দেখেই বিশ্বাসটা দৃঢ় হয়, একলা এসেও একাত্ম হতে ইচ্ছে করে!
একনজরে:– ত্রিযুগিনারায়ণ শোণপ্রয়াগ থেকে প্রায় ১৪কিমি দুরে ৭২০০ফুট উচ্চতায় অবস্থিত৷ কেদার পথের বেশিরভাগ যাত্রীই একফাঁকে ঘুরে যান ত্রযুগির মন্দির, তবে কেউই প্রায় রাত্রিবাস করেন না, অথচ দু’-এক রাত্রি কাটানোর জন্য হিমালয়ের এই মনোরম জনপদ অত্যন্ত আদর্শ বলেই মনেহয়! জি এম ভি এন-এর আধুনিক বাংলো, কালীকমলি পুরোনো ধর্মশালা ছাড়ও আছে অনেক ছোটো ছোটো হোটেল৷ ত্রিযুগি মন্দিরে জ্বলতে থাকা আগুন কখনও নিভে যায়না বলে একে অখন্ডধুনি মন্দিরও অনেকে বলে থাকেন৷ প্রায় কেদারনাথের আদলে তৈরী এই মন্দিরে নারায়ণ, লক্ষ্মী ও সরস্বতী মূর্তি বিরাজমান৷ এখানে মেলা বসে বামন দ্বাদশী তিথিতে৷
0 Comments