হর-কি-দুন কি লালি

Published by Editor on

হরকিদুন এর পথে

হর-কি-দুন কি লালি

– সুমন্ত মিশ্র

হরকিদুন গেলাম সেবার । চার বন্ধু মিলে পূজোর পরেই বেরিয়েপড়া, -দেরাদুন, শাঁকড়ি হয়ে তালুকা-সীমা-ওসলা পেরিয়ে হর এর আপন তালুক হর-কি-দুন! শাঁকড়ি হল দোতলা একটা গ্রাম, -একতলায় চাষবাস সহ বসবাস আর দোতলায় দোকানপাট ও বাইরের জগতের সাথে যোগাযোগ। দু’রাত্রি সেখানে কাটিয়ে জোগাড় হল আমাদের পথের দিশারী – জ্যোত্ সিং। গৌতম অবশ্য সারাটা পথ ওকে বিকৃতনামেই ডেকে গেল!
পিঠে রুকস্যাক্ ফেলে পায়েপায়ে হাঁটা দিলাম শাঁকড়ি থেকে তালুকা, -১ঘন্টার পথ। বড়বড় গাছের ছাওয়ায় পাথুরে চওড়া রাস্তা, বাঁদিকে পাহাড়ের ঢালে শরতের সোনালী রোদ্দুরে রামদানার ক্ষেত, – রক্তলাল হয়ে উজ্জ্বল! তালুকা পৌঁছে জ্যোত্ সিং বলল –“নাস্তা করলো সাব”। সেইমত এক পাহাড়ি দিদির দোকানে খেতে বসলাম, বরবটি-আলুর তরকারি আর গরম গরম রুটি দিয়ে সারা হল সকালের নাস্তা। রওনা দিলাম সীমা’র পথে। কিছুদুর এসেই খেয়াল করলাম একটা লাল রঙের পেল্লাই সাইজের ভল্লুক সদৃশ্য কুকুর আমাদের সঙ্গ নিয়েছে, -নাম দিলাম ‘লালি’। সহজ উঁচুনীচু পাহাড়ি পথে ওই হল আমাদের পথপ্রদর্শক –চলেছে সবার আগে আগে। অবাক ব্যাপার যেখানেই রাস্তা একটু কঠিন, কেউ হয়ত পিছিয়ে পড়েছি বাকিদের থেকে – সঙ্গী থেকেছে সেই লালি।

অদ্ভুত এক দৃশ্য দেখেছিলাম হরকিদুন এর এই রাস্তায়, – রাস্তার দুধারে আগাছার ঝোপ, স্থানীয় বাচ্চারা সেইসব ঝোপে দাঁড়িয়ে অবিরাম গাছের ডগাগুলিকে নিজেদের তালুবন্দি করে ঘষে চলেছে! রহস্য জেনেছিলাম পরে,- জ্যোত্ সিং এর কাছে! আসলে ঐ আগাছাগুলো সবই আফিম গাছ, আর ওর ফলগুলিকে ঐভাবে হাতে করে ঘষে ঘষে বাচ্চারা চরস তৈরী করছে, পরে মুঠোভর্তি বিক্রি করছে পথচলতি মানুষদের কাছে ১টাকা ২টাকার বিনিময়ে! ফেরার পথে অবশ্য শাঁকড়িতে সারারাত সেই চরস ট্রাক বোঝাই হয়ে দিল্লী চালান হতেও দেখেছি। যাক সেসব কথা, ৪ঘন্টায় সীমা পৌঁছে বনবাংলোয় বিশ্রাম! সামনেই চড়াই ভেঙ্গে ওসলা গ্রাম, যে গ্রামে দুর্যোধন পূজিত হন আজও! ওসলাতেই আমাদের চোত্ সিং-এর বাড়ী, তাই রান্নাকরে ও গেল পরিবারের সাথে সময় কাটাতে।

স্বর্গারোহিনীর পথে

পরদিন সকাল ৮টায় সিয়ানগাড্ এর ওপর ছোট্ট কাঠের পুল পেরিয়ে হরকিদুন এর রাস্তা ধরলাম। পুল নাপেরিয়ে সোজা রাস্তা চলে গেছে রুঁইসারাগাড্ এর দিকে। সকালের নরম রোদে পাহাড়ি মেয়েরা চলেছে ক্ষেতের কাজে। আমাদের দেখে তাদের অহেতুক হাসাহাসি – বিব্রত বোধ করি! খানিক বাদে নিজেরাই কাছে এগিয়ে এসে হাত পাতে –“মিঠা সাব”, মানে আমাদের কাছে লজেন্সের প্রার্থণা! প্রকৃতির আপন খেয়ালে বেড়েওঠা সুন্দরীদের আবদার মেটাতে সবাই দরাজ হয়ে উঠি। আবার এগিয়ে চলা – সকাল পেরিয়ে দুপুর গড়িয়ে সন্ধ্যের মুখে হরকিদুন। ‘পেটে ছুঁচোর ডন’ কি মারাত্মক হতেপারে টের পেয়েছিলাম সেদিনই! পোড়া আলু খেয়ে সে যাত্রা নিস্তার! রাতে চাঁদের আলোয় গেষ্টহাউসের খোলা বারান্দায় স্বর্গারোহিনীর সঙ্গে জেগে রইলাম অনেকক্ষন, -হাড় হিম্ করা ঠান্ডায় আমার সঙ্গী রইল লালি।

হরকিদুন

রাত্রি ক’টায় ঘরে গিয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকেছি খেয়াল নেই! পাশেই কাঠের মেঝেতে কম্বলের ওপর লালির বিছানা। সকলের নাকডাকার আওয়াজে নিজেও কখন ‘নাক ডাকিয়ে’ ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানিনা, ঘুম ভাঙ্গল স্লিপিং ব্যাগের ওপর হাঁচরপাঁচর আওয়াজে! – দেখি মুখের কাছে মুখ এনে কুঁইকুঁই করে লালি কিছু বলতে চাইছে! ভাবলাম রাতবিরেতে প্রাকৃতিক ক্রিয়ার টানে ও হয়ত বাইরে যেতে চাইছে। দরজা খুললাম, ও কিন্তু না বেরিয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে রইল আমার মুখের দিকে তাকিয়ে। কি করব বুঝে উঠতে পারছি না। এমন সময় জ্যোত্ সিং কম্বলের ভেতর থেকে মুখ বার করে বলল – “উসকি ভুখ লাগি হ্যায় সাব, রাতকো কুছ খায়ি নেহি।” শুনলাম রাতের মেনু খিচুড়ি-আলুভাজা ওর পছন্দ হয়নি। এখন ওর জন্য কি খাবারের ব্যবস্থা করি! রেশনের ব্যাগ খুলে বিস্কুট বার করে দিলাম, সে ও মহারাণীর মুখে উঠল না! মনে পড়ল ওর লজেন্সে আসক্তির কথা। এই দু’দিন রাস্তায় চলার পথে সবার কাছেই ওর প্রার্থিত বস্তু ছিল একটাই – লেবূ লজেন্স। গোটাকতক বার করে দিতেই কুড়মুড়িয়ে খাওয়া সাঙ্গ, – দিব্যি নিশ্চিন্ত বিছানায় আশ্রয়।

পরেরদিন যমদ্বার গ্লেসিয়ার ঘুরে আবার ফিরে চলা, সেই ওসলা-সীমা হয়ে তালুকা। তালুকা পৌঁছে এবার জিপ্ পাওয়া গেল, – মাথাপিছু ২০টাকা ভাড়ায়। তাতেই শাঁকড়ি যাওয়া স্থির হল। মুশকিল হল লালিকে নিয়ে,  কিছুতেই সঙ্গ ছড়বে না। খুঁজেপেতে ওর মালকিনকে ডেকে নিয়ে এলাম,  তাতেও কাজ হলনা। একদৃষ্টে জিপের মাথায় আমাদের ব্যাগ বোঝাই হতে দেখল। মাথায় হাতবুলিয়ে, আদর করে কিছুতেই ওকে অন্যদিকে নিয়ে ষাওয়া গেলনা। এমনকি ওর প্রিয় লজেন্সও প্র্রত্যাখ্যান করল। জিপে চড়লাম, -লালিও লাফ দিয়ে চড়তে চায়। ড্রাইভারকে তাড়া লাগালাম, গাড়ী ছাড়ল, পেছন পেছন ও ছুটে আসছে – স্পিড বাড়ছে –একসময় ও দাঁড়িয়ে গেল, করুণ দু’টি চোখ – আর পেছনে তকালাম না।

মায়াময় বিস্ময়েভরা ওই দুচোখ হয়ত বুজে গেছে চিরতরে,  করুণ সে চেখের আর্তি ভুলতে পারিনি আজও


0 Comments

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!